তোমার নাম কী গো ফর্সা বরণ মেয়ে

Published by সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর on

মোশারফ বয়সে আমার চেয়ে মাস ছয়েকের বড়, চাচাতো ভাই। বিয়েটা এখনো হলো না ওর। এনজিওতে মোটামুটি তবকার চাকরি করে, একটা ব্রাঞ্চের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। বেতন একেবারে ফেলনা নয়। অফিস থেকে মোটর সাইকেল দিয়েছে, রোজ সকাল আটটায় বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে, ফিরতে ফিরতে বিকেল-সন্ধ্যা। কী শীত কী গরম, সকালে বেরোনোর সময় ফি দিন গোসল করে বেরোতে হয়। পাশাপাশি বাড়ি, রোজ রোজ আমি ওকে দেখি আর আফসোস করি—আহা! আমার যদি অমন একটা দশটা-পাঁচটার অফিস থাকতো, মরেই যেতাম আমি!

এতদিন অপেক্ষা করেছে ঘরদোর ঠিক করার জন্য, একটা যুতমতো বাড়িঘর না হলে বিয়ে করবে না। এবার বাড়িঘর হয়েছে, ওরা দুই ভাই মিলে বাড়িতে বিল্ডিং তুলেছে। বেশ দেখার মতো বিল্ডিং। দোতলা ফাউন্ডেশন, একতলার কাজ প্রায় শেষ। লেপ-পুছের কাজ চলছে। অঢেল টাকা যাচ্ছে। নিজেদের পুঁজি শেষ হয়ে এলেও কাজটা শেষ করতে পেরেছে। লাভের মধ্যে, ওর দুলাভাইয়ের ইটভাটা আছে, ইট যা লাগে সস্তায় বা বাকিতে আনা যায়। যাক, মোটামুটি থাকার মতো এবার বিল্ডিংটা দাঁড়িয়েছে। তো, এবার বিয়েটা সেরে ফেল! বাড়ি এলেই আমি তাগাদা দেই।

মাস ছয়েক ধরে এখানে সেখানে পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছে। ওর পছন্দ হলে বোনের হয় না, বোনের হলে মা’র হয় না। কোনো পাত্রী পছন্দ হলে বাড়ি পছন্দ হয় না, বংশ-পরিবেশে গন্ডগোল। এভাবে চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে, কোনোভাবে আর আখেরটা গোছানো যাচ্ছিল না। ছোট ভাই মনিরুজ্জামান পঞ্চম অবশ্য একটা কাজের কাজ করেছে। নিজের গরজে আমাদের গ্রামেরই এক মেয়েকে পছন্দ করে বাড়িতে জানিয়েছিল মাসখানেক আগে, বিয়ে সে ওখানেই করবে। বাড়ির মুরব্বিরা নিমরাজি থাকলেও শেষে আর না করতে পারেনি, দিন পনেরো আগে গিয়ে আংটি পরিয়ে এসেছে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে পাকা, বড় ভাইয়েরটা না হলে হয়? সবারই ইচ্ছা, দুই ভাইয়ের বিয়ে একসঙ্গে হবে। সুতরাং মোশারফকে যা করতে হবে—চটজলদি। হাগবা না আবার পথও ছাড়বা না, এমন করা যাবে না বাপু!

 

দুই

সকাল নয়টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি চাচিআম্মারা রোদে বসে গল্প করছে। সেখানে মোশারফ আর ওর আব্বা, মানে মালেক কাক্কাও বসা। আলোচনা করছে মোশারফের বিয়ে নিয়ে। আজকেও নাকি পাত্রী দেখার আয়োজন আছে। কাক্কা মোশারফকে জোর করছে পাত্রী দেখতে যেতে। অবশ্য পাত্রী দেখতে মোশারফের আগ্রহের কোনো কমতি নেই, গত ছয় মাস ধরে সে নিরন্তর পাত্রী দেখে যাচ্ছে। পাত্রী দেখতে দেখতে সম্ভবত নেশার মতো ধরে গেছে, সপ্তাহে দু-একটা না দেখলে এখন মনে হয় শরীর কিড়মিড় করতে থাকে। আমাকে বহুবার বলেছে ওর সঙ্গে যেতে, নানা ঝামেলায় যাওয়া হয়নি। আজকে হুট করে বলে বসলো, ‘চল তো, একটা পাত্রী দেইখা আসি!’

পাত্রী দেখতে যাওয়ার মতো একটা অভব্য ব্যাপারে আমার বরাবরই অনাগ্রহ। আমি বললাম, ‘কাক্কা আর ইলোরারে নিয়া যা! ইলোরা ভালো দেখতে পারবে।’

ইলোরা ছোট চাচার মেয়ে, সোমত্ত। তার বিচার-বুদ্ধি ভালো, অবিচার-বুদ্ধি কম।

যাকগে, আমার গররাজি দেখে চাচিআম্মারা আর আমার মা’ও অনুরোধ করলো একবার পাত্রী দেখে আসতে। অবশেষে রাজি না হয়ে উপায় রইলো না। গোসল করে তৈরি হয়ে রওনা দিলাম মোটর সাইকেল নিয়ে, মোশারফ আর আমি। ও বিয়েপ্রার্থী, সঙ্গে আমি মুরব্বি হিসেবে! সুয়াল-জওয়াব আমাকেই করতে হবে। এমন আনন্দের চে বিষের বাঁশী বাজানো শ্রেয়!

সম্ভবত এটাই আমার জীবনের প্রথম পাত্রী দর্শন। এর আগে শুধু নিজের বউকে দেখতে গিয়েছিলাম। ওই একটাই! এইটুকুন পিচ্চি একটা মেয়ে, কীভাবে যেন একবার দেখাতেই হয়ে গেলো বিয়েটা!

 

তিন

পাত্রীর বাড়ি বালিয়াটী। ধামরাইয়ের পাশে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটী জমিদারবাড়ির পাশেই পাত্রীর সাং-ঠিকানা। অথচ কী দুর্ভাগ্য আমার, কখনো এ জমিদারবাড়ি দেখতে আসিনি আমি। আজকে যখন জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে গেলাম তখনও দেখতে ইচ্ছে করলো না। জীবনের রস-কষ সব উধাও হয়ে গেল নাকি! অথচ আমার বউ দু-তিনবার এসেছে।

পাশে বলতে পাশে, জমিদার বাড়ির সামনের পুকুরের পুবপাশেই মেয়েদের বাড়ি। বাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে জমিদারবাড়ির প্রাসাদ নজরে আসে। ঘটক আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছেন। সাটুরিয়া অপেক্ষা করছিলেন, আমরা আসতেই আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন বালিয়াটী। বাড়ি থেকে সাটুরিয়া আসতে মোটর সাইকেলে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট, সেখান থেকে বালিয়াটী মিনিট পাঁচেক। কাছেই তো, আমি মনে করেছিলাম বালিয়াটী বেশ দূর।

বড় বড় দীঘি, দীঘির পাশে লম্বা টিনের ঘর, মেঝে লেপা মাটির। আজ সকালে মনে হয় নতুন এক প্রস্থ লেপা হয়েছে। সকালে অবশ্য ঘটককে বলা হয়েছিল, কোনো রকম আয়োজন যাতে না করে। আমরা শুধু হাঁটা-বাউলী মেয়ে দেখে চলে আসবো। হালকা পানি-শরবত হলেই চলবে। কিন্তু এ বাড়িতে এসে মনে হলো, তারা কিছুটা হলেও আয়োজন করছে, ঘর লেপা দেখেই বুঝা গেলো। সামান্য আয়োজনে কেউ ঘর লেপে না। তবে এখানেও কথা আছে, মেহমানকে সম্মান করার বিষয়টা বড় করে চোখে ধরা পড়ল।

বাড়িতে যাওয়ার পরই মেয়ের বড় ভাই এসে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে আমাদের পশ্চিম পাশের ঘরে নিয়ে বসালো। এক চালের লম্বা বাড়ি, মাঝখানে টিনের বেড়া দিয়ে আলাদা আলাদা কামরা করা হয়েছে। আমরা পশ্চিম পাশের যে কামরায় বসেছি, তার পাশেই বিরাট দীঘি। জানালা দিয়ে লাফ দিলে পুকুরে পড়া যাবে। মনে মনে ভাবলাম, মোশারফ এ বাড়ির জামাই হলে ভালোই হবে, যখন ইচ্ছা জানালা গ’লে লাফ দিয়ে দুটো ডুব মেরে গোসল সেরে আসবে।

বাড়ির সামনে দুয়ার, দুয়ারের সামনে কবুতরের খোপ, অনেকগুলো। বেশকিছু কবুতর বাকবাকুম করছে, পাখা খুঁটছে, আধার খাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে মেয়ের ভাইকে জিজ্ঞাস করলাম, কবুতর কতোগুলো? জানালো, এখন বেশি নেই, পঁচিশ-তিরিশ জোড়া আছে। বছরখানেক আগে নব্বুই জোড়া ছিল। একবার ঠা-ার জন্য একটা ওষুধ খাইয়েছিলাম, তার পর থেকে বাচ্চা হওয়া কমে গেছে। আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম। সে বলতে গিয়ে থতমত করতে লাগলো। পরে বুঝলাম, সে আমার সামনে প্রজনন ব্যাপারটা উচ্চারণ করতে দ্বিধায় ভুগছে। সেই ওষুধ খেয়ে কবুতরের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন আর খুব বেশি বাচ্চা হয় না। তাই অনেক কবুতর বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বা খেয়ে ফেলা হয়েছে।

কবুতরের খোপ দেখেও বাড়ির মানুষের মেজাজ-মর্জি আর রুচিবোধ কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

কিছুক্ষণ পর মেয়ের বাবা এলেন। বয়স্ক, চুল-দাড়ি পাকা, গায়ে জুব্বা মাথায় টুপি, চেহারায় হাসি মাখা। পানি আর ফল নিয়ে এলেন। তার সঙ্গে অবশ্য ঘটক আংকেলও সাহায্য করছিলেন। আমাদের বসতে দেয়া হয়েছে চকিতে। নতুন চাদর বিছানো হয়েছে। ঘরে একটা টেবিল, তিনটে প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চ রাখা। একপাশে একটা স্টিলের আলমারি, একটু না—বেশ খানিকটা হেলে আছে পেছনদিকে। পড়ে না যায় আবার!

মেয়ের বাবা বেশ কথাবাজ লোক। আমাদের সামনে চেয়ারে বসে কথা শুরু করলেন। মোটামুটি তার বংশপরিচয় থেকে শুরু করে নিজের কাজ-কারবার সব বলে গেলেন। দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে বিএ পাশ করে ছোটখাটো চাকরি করছে আর সরকারি চাকরির বন্দোবস্ত করছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের কী একটা চাকরিতে তদ্বির চলছে। ছোট ছেলে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছে। কিন্তু সে এক প্রকার ত্যাজ্য। কারণ তো সেই প্রাচীন, প্রেম করে বিয়ে করেছে নিজের টিউশনির ছাত্রীকে। এলাকারই মেয়ে, কিন্তু ঘর ভালো না। ছেলের এমন কীর্তি বাবা মেনে নেয়নি। গ্রামেই নিজেদের আরেকটা বাড়ি আছে, ছেলেকে বলেছে সেখানে গিয়ে থাকতে। এ বাড়িতে তার স্থান নেই। ছেলে সেখানে থাকে ছাত্রীবউ নিয়ে, সেও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেছে। এমনিতে কোনো চাকরি করে না, অংকের ছাত্র ছিলো—টিউশনির ব্যাচ পড়িয়ে বেশ কামাই করে। বাপেরও খুব একটা দরকার হয় না তার। তবুও তো থেকে যায় একটা জিনিস—মায়া। বাপের ভিটা, মায়ের সংসার, ভাই-বোন! থাকে তো এসব, জুদা হলেই তো আর ফেলা যায় না!

আমার সেসবের তলানী খুঁজে কী লাভ, কেবলই তো দু লমহার চিন-পেহচান। আমরা বরং ফল খাচ্ছি—আঙুর, আপেল, কমলা। আমি অল্প খাচ্ছি, মোশারফ বেশি খাচ্ছে। কী কা-! তুই পাত্র, একটু ভদ্র সদ্র হয়ে অল্প খাবি না! সে বালাই নেই।

সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। জুমআর দিন, আমাদের ইচ্ছা—নামাজের আগেই মেয়ে দেখে বাড়ির পথ ধরবো। বাড়িতে আবার খরচের দাওয়াত আছে সাইফুল কাক্কার বাড়িতে, সেখানে ভালো একটা ভুরিভোজ দিতে হবে। কিন্তু বিধিবাম! মেয়ের বাড়িতে নাকি সামান্য আয়োজন করা হচ্ছে। আমরা ওজরখাহি করলাম, কিন্তু মেয়ের বাবা বললেন, তার বাড়িতে এসে না খেয়ে তিনি কোনো মেহমানকে যেতে দেন না। এ যেন মুঘলের সাথে খানা খাওয়ার অবস্থা! কী আর করা, জলদি খাওয়াপর্ব শেষ করে কনেদেখা পর্ব সামাধা করতে হবে।

খাবার এলো। চিনামাটির প্লেট দেয়া হলো আমাদের। সিরামিকের এসব প্লেটকে আমার দাদি বলতেন ‘চিনির বাসন’। আয়োজন বেশি না, সেদ্ধ ডিম ভাজা হয়েছে, গোল করে কাটা বেগুন ভাজা আর দেশি মুরগির সালুন, সঙ্গে রাজভোগের পোলাও। রান্না একেবারে মন্দ না, কনের বাবা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই খাওয়ালেন আমাকে। হুজুর বলেই কিনা!

খাওয়া দাওয়া শেষ করে কনেকে হাজির হওয়ার তাগাদা দিলাম। বাড়িতে লোকজনের কমতি চোখে পড়লো। অবশ্য শর্ট নোটিশের দেখাদেখি, লোকজন আর কে আসবে! কবুতর বাকবাকুম করছে।

একটু পর ঘটক এসে জানালো, মেয়ে এখনই দেখাবে-আসছে। শুভ সংবাদ।

মেয়ে এলো। লাল রঙের একটা চমকদার শাড়ীপরা (লাল না খয়েরি?)। মাথায় ঘোমটা, মেকআপচর্চিত মুখ, লিপস্টিক তো থাকবেই, নাকি? হাতে সোনা বা ইমিটেশনের চুড়ি, আঙুলে আংটিও পরেছে সম্ভবত, অতো খেয়াল করিনি। পায়ে জড়িদার নাগরা জুতো (এটা পরে খেয়াল করেছি, চলে যাবার সময়)। এসব খেয়াল করতে হয়। কারণ, কনে পাত্রপক্ষকে কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা বিয়ের ব্যাপারে সে কতোটা ইচ্ছুক, এসব বুঝা যায় তার সাজ এবং পোশাকের আন্তরিকতা দেখে। আগেই মেয়ের যদি পাত্র পছন্দ না হয় তবে সে এতো আন্তরিকতা নিয়ে সাজবে না এবং কথা বলবে ঠাঁট দেখিয়ে, কথার মধ্যে সম্ভ্রম বা লাজুক ভঙ্গি থাকবে না।

এসব বিষয় আমি কালই আবিস্কার করলাম, আগে কখনো বুঝিনি। কীভাবে বুঝলাম, সেটা পরে বলছি।

মেয়ে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো। সালাম যথেষ্ট ভব্য। আমাদের সামনে রাখা টেবিলের অপর পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে এসে বসলো। সঙ্গে আরও দুজন বোন গোত্রীয় মেয়ে এসেছে, বিবাহিত। তারা আসতেই মেয়ের বাবা আর ঘটক বাইরে চলে গেলেন। আহা! কী ফ্রেন্ডলি প্যারেন্টস!

কয়েকটা মুহূর্ত চলে গেলো—কী বলবো? অথচ যা বলার আমাকেই বলতে হবে। ঘরে আমি আর মোশারফ, বরপক্ষ। ও পক্ষে কনে, দুজন বিবাহিতা আর দুটো কাচ্চা বাচ্চা—এই। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কথা শুরু করলাম, ‘কী নাম তোমার?’

‘আয়েশা।’ বাহ বাহ! মাশাআল্লাহ!

‘কোথায় পড়ো?’

‘কালু শাহ কলেজে?’

‘কোন ক্লাসে?’

‘ইন্টারমিডিয়েট…!’

এবং বুঝতেই পারছেন, আরও কিছু হাবিজাবি কথা জিজ্ঞেস করলাম। করতেই হয়, মেয়ে লাজুক স্বরে জবাব দিলো। কুরআন পড়তে পারে কিনা, বললো, অল্প স্বল্প। সুরা কাউসার পড়ে শোনালো, একেবারে মন্দ না। আমার কথা ফুরিয়ে যায়। মোশারফ আগেই বলে দিয়েছিলো, মেয়ের উচ্চতা জিজ্ঞেস করবি। জিজ্ঞেস করার পর বলবি, বর-কনে একটু একসঙ্গে দাঁড়াও দেখি। তারপর দুজনের উচ্চতা মাপবি।

আমি মেয়ের উচ্চতা জিজ্ঞেস করলাম। মেয়ে বললো, সে কখনো উচ্চতা মাপেনি। আমার ভাল্লাগলো—মেয়ে চানক্য টাইপের নয়, যখন তখন ওজন আর প্রস্থ মাপে না। তবে মেয়ে যথেষ্ট লম্বা, মোশারফের চে উঁচু বৈ কম নয়। দুজনকে একসঙ্গে দাঁড়াতে বললাম। গোটা পাঁচেক ছবিও তুলতে হলো পাত্রের জন্য, আগেই এমন পরিকল্পনা করা হয়েছিল—পাত্রের অনুরোধ।

যাই বলেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে। বেশি পছন্দ হয়েছে মেয়ের বাবাকে—দিলখোলা মানুষ। মনে কালি নাই।

কনে দেখা শেষ করলাম। পুরো পর্বটা মিনিট পাঁচ-সাতের বেশি হবে না। মোশারফ আমার কাছে আগেই টাকা দিয়ে রেখেছিলো ৭০০। যদি খাওয়া দাওয়া কম আর পাত্রী পছন্দ না হয় তবে দিবি ৫০০, আর পাত্রী পছন্দ হলে তো কথাই নেই—গোটা ৭০০ দিয়ে দিবি। জীবনে আছে আর কি, খ্যাতা আর বালিশ! আমি খ্যাতা-বালিশের নাম করে পকেটে হাত দিয়ে গোটা ৭০০ টাকা মুড়িয়ে এনে মেয়ের হাতে দিয়ে দিলাম। দেখাপর্ব এখানেই শেষ!

 

চার

নামাজ পড়লাম জমিদারাড়ির সামনের মসজিদে। নামাজের পর ঘটক সাহেবকে পেছনে বসিয়ে সাটুরিয়ার দিকে আসছি, তখন তিনি বললেন, মেয়ে আরেকটা আছে—দেখবেন নাকি? আমি প্রমাদ গুনলাম—বলে কি! একদিনে দুই পাত্রী! পুরোই প্রফেশনাল কাজ কারবার। দেখলাম মোশারফও রাজি। আমি মোটর সাইকেলে বসেই ওর পেটে খোঁচা দিলাম—বলি, হচ্ছেটা কী মশাই?

ঘটক বললো, বেশি সময় লাগবে না, সাটুরিয়া থেকে তিন-চার কিলো, গিয়ে দেখবেন শুধু। মেয়ে ওটা আগেরটার চেয়েও চেহারায় সরস, গায়ে-গতরেও ভালো। লে বাবা! পুরো ফিটনেসের বর্ণনা দিবে নাকি এবার!

গ্রামের নাম জান্নার চর, সেই গ্রামের পাশের গ্রাম কামতা—কেমন উদগ্র নাম! কিসের তিন-চার কিলো, মোটর সাইকেল চালিয়ে প্রায় দশ কিলো আসতে হলো, একেবারে মানিকগঞ্জ হাইওয়ের পাশে। পাত্রীর বাড়ি একটা পাড়ার ভিতরে, ঘটক পাত্রীর বাড়িতে গেলো আর আমরা রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। বাড়ির লোকজন সম্ভবত প্রিপারেশন নিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরই ঘটক এসে অন্দরে প্রবেশের অনুরোধ করলো। দুই বাড়ি পাড়ি দিয়ে কনের বাড়ি গেলাম। মেঝে প্লাস্টার করা উঁচু ভিটার বাড়ি। সামনে উঠানের দক্ষিণ পাশে চারটে কালো গরু বাঁধা, বাড়ির সামনেই। ল্যাদা-গোবরে যাচ্ছেতাই। ঘরে ঢুকলাম, কিন্তু ঘরে লক্ষী নেই। বিছানার চাদর ময়লা, মেঝে অপরিস্কার, চালের নিচে টানানো শামিয়ানায় মাকড়সার ঝুল—মোটামুটি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বুঝাই যাচ্ছে, মেহমানের আগমনের ব্যাপারে তারা মোটেও খেয়ালি নয়। তাছাড়া, যে বাড়িতে একটা সোমত্ত মেয়ে আছে, সে বাড়ির চেহারা এমন থাকাটা মোটেও মেনে নেয়া যায় না। অবিবাহিত মেয়ে যে বাড়িতে থাকবে সে বাড়ির চেহারা সবসময় টিপটপ থাকবে। মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষী, ঘর গুছিয়ে রাখার কাজটা জানতে হবে। কিন্তু সেটা যে সে করতে জানে না, সে তো ঘরে ঢুকেই বুঝে গেলাম।

একটু পর মেয়ের বড় ভাই এলো। কথাবার্তা হলো কিছু। জলখাবার এলো, মোশারফ এখানেও হাপুস করে খেতে লাগলো। ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না!

আমাদেরও জলদি, মেয়েকে আনতে বললাম। মেয়ে এলো। ইজুয়্যাল সালোয়ার-কামিজ পরে ঘরে ঢোকার মুখে ঠাস করে একটা সালাম দিলো। সালামের আওয়াজ শুনেই মোটামুটি বুঝে গেলাম, মেয়ে বিয়েতে গররাজি। কিছু আর জিজ্ঞেস করতে তেমন একটা মন থেকে সায় পেলাম না। তবু ফাংশনাল কথাবার্তা জিজ্ঞেস করলাম। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে দু বছর আগে, অনার্সে ভর্তি হবে হবে করছে, ভাই ভর্তি হতে দিচ্ছে না সম্ভবত।

যাকগে, বিশদ বর্ণনা আর দিবো না। মেয়ের মুখ আর কথার ধরন ভালো লাগলো না। দু-চার কথায় শেষ করলাম কনেদেখা মচ্ছব। ৫০০ টাকার একটা নোট না দিলেই নয়, তাই হাতে গুঁজে দিলাম। আমরাও আর দেরি করলাম না, সালাম-কালাম জানিয়ে চলে এলাম।

আসার পথে মোশারফকে জানিয়ে দিলাম, বিয়ে করতে হলে ওই বালিয়াটীই করতে হবে, বাছা। বহুত দেখাদেখি হয়েছে, বেশি দেখলে স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে। অলরেডি হয়ে গেছে কিনা কে জানে। সুতরাং স্বভাব খারাপ হওয়ার আগে আগেই একটা শক্তমতো নোঙর গেঁড়ে ফেলো। তারও খুব একটা অমত দেখলাম না। বিয়েটা বালিয়াটী হলে মন্দ হয় না। পাশেই জমিদারবাড়ির পর্যটন লোকেশন, কলাও বেচা হবে আবার রথও দেখা হবে।

পাত্রী দেখে বাড়ি ফেরার পথে আমরা আসন্ন বিয়ে নিয়ে নানা প্ল্যান পোগ্রাম সাজাতে লাগলাম। বয়স তো হয়েছে, এখন প্ল্যানটাই আসল, প্রেম কি আর উদ্গত হয় নিষ্ফলা হৃদয়ে!

পুনশ্চ : তিন দিন পর ঘটক মারফত খবর পেলাম—বালিয়াটীর মেয়েটার একটা দোষ আছে। মেয়েটা বছরখানেক আগে এক ছেলের সঙ্গে ভেগে গিয়ে বিয়ে করেছিল। ছেলের সঙ্গে দু’দিন ছিলো, তারপর কী মনে করে যেন আবার একাই চলে এসেছিল। বাহ, বাড়ির হারিয়ে যাওয়া পোষা কবুতর বাড়ির খোপে চলে এসেছে, আমাদের কী করার আছে! শুধু আরেক শুক্রবারের ইন্তেজার। আবার ৫০০ টাকার লাল অথবা সবুজ দুটো নোট। আবার লেপা মেঝের ঘর, রাজভোগের পোলাও, লজ্জামুখে জিজ্ঞেস করা—‘তোমার নাম কী গো ফর্সা বরণ মেয়ে?’