প্রিয় আকাশী
সারা রাত আকাশভাঙা মনমাতানো বৃষ্টি হয়েছে
রাতে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, টের পাইনি
জানালার পাশে পাতারা ভিজেছে রাতভর
ঘুম ভেঙেছে পাতার গায়ে বৃষ্টিজলের শব্দে
তুমি পাশে নেই
কার্তিকের এ বর্ষাতি ভোরেও পেলাম ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া
ঘুম ভেঙে বিছানা হাতড়ে তোমার উষ্ণতা পাবার কথা মনে হয়েছিলো একবার
কিন্তু অতোটা ছেলেমানুষ নই আর…
বড় হয়ে গেছি, বয়স তিরিশের কোটায়
শিখে গেছি দীর্ঘশ্বাস লুকানোর সহজ কলাকৌশল
যদিও তোমার মতো অতোটা তুখোড় খেলুড়ে নই
তবুও শিখে গেছি, তোমার থেকে কষ্ট ভোলার ব্যকরণ
মনে হয় এই একটা ব্যাপারে আমি তোমার ছাত্র হয়ে আছি

বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিলো, মুআজ্জিনের আজান শুনতে পেলাম
কী করুণ মনে হলো, মনে হলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার গায়ে
মিশে যাচ্ছে আজানের করুণাধারা, বিরহের বিন্দু বিন্দু ছাপচিত্র
সকালের ধূসর আঁধারে প্রতিটি বৃষ্টিফোঁটা মন খারাপ করে ছিলো
প্রতিটি বাতাসকণা ছিলো ঘুর্ণয়মান ধূমকেতুর মতো তীক্ষ্ম আর তীব্র
তুমি জানো, এই শীত শীত হেমন্তভোরেও
আমি তোমাকে প্রদক্ষিণ করেছি এক লক্ষ তেত্রিশ হাজারবার

প্রিয় আকাশী
এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে
বানের জলে ভেসে গেছে শত শত গ্রাম-লোকালয়
নদীর ভাঙনে গৃহহারা হয়েছে সহস্র পরিবার
ফসলের জমি, ফলানো বীজতলা, কৃষকের স্বপ্ন তলিয়ে গেছে
তবু মানুষ থেমে নেই, মানুষ নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখবে
আবার তারা নতুন আশা নিয়ে উৎপাদন করবে শস্য, জন্ম দেবে সন্তান
আবার মানুষ একদিন বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হবে এবং একদিন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবে
আমিও আবার একদিন খুব বৃষ্টিভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠবো
আর ঘুম থেকে জেগে দেখবো, আমার পাশে ঘুমিয়ে আছো তুমি
জুবুথুবু শিশুর মতো, মাতৃজঠরে কুণ্ডলি পাকানো ভ্রুণের মতো
সহায়হীন, যাবতীয় পার্থিব সম্বলহীন, কলুষমুক্ত পাপহীন
তোমাকে আমি গড়েছি স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো
আমার স্বাধীনতার প্রতীকের মতো তুমি ঘুমিয়ে আছো
তোমার প্রতিটি ভঙ্গিমা একেকটি স্ট্যাচু, একেকটি বার্থ অব ভেনাস
আমার সকল বিশ্বাসেরা নিশিদিন তোমাকে দেখতে আসে
তুমি দিন দিন হয়ে উঠছো আমার হৃদয়ের চিত্তাকর্ষক পর্যটনবিহার
আমার পৃথিবীর সবচে মূল্যবান প্রাগৈতিহাসিক তৈলচিত্র- তোমার ঘুমন্ত মুখ
আমার রক্তের সকল শিলালিপি তোমার দর্শনোন্মুখ পর্য্টক

প্রিয় আকাশী
এ বছর সম্ভবত আর বৃষ্টি হবে না
আজ দশই কার্তিক, সন্ধ্যাবেলা শুকতারা উঠে খুব তাড়াতাড়ি
গোঁধূলী ম্লান হওয়ার আগেই দক্ষিণ ঈশানে জ্বলজ্বল করে
গতকালও দেখেছি, আকাশ ছিলো ধু ধু নীল, ফেনিল সাদা সাদা
অথচ রাতভর কী বৃষ্টিই না হলো

কাল ছিলো কৃষ্ণ দ্বাদশী, আজ উত্তরফাল্গুনী
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের ফলে সারাদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন
কার্তিকের এই বেহুলা বিকেলেও হাওয়ার মাতামাতি
হেমন্তের পাতাঝরার শব্দের বদলে আমার চারপাশে বৃষ্টির ঘ্রাণ
মিহি হাওয়া এসে পায়ের কাছে মুখ মুচড়ে বসে থাকে
আমার তখন অপ্রকৃতস্থ হয়ে যেকে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে, পুকুরপাড়ের কদম গাছটায় গিয়ে বসি
অথবা দূর দিগন্তে চলে যাই হাঁটতে হাঁটতে
পেছন থেকে তুমি তাকিয়ে দেখবে
আমি ভায়োলিন বাজিয়ে চলে যাচ্ছি
বিল, লোকালয়, পথ, নদী, নাগরিক কোলাহল ছেড়ে
হেঁটে যাচ্ছি একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো
আর আমার পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে মাইলকে মাইল, যোজন যোজন ক্রোশ
পাড়ি দিয়ে তোমার দৃষ্টি আমার পিঠে ছোরা গাঁথার মতো গেঁথে আছে
দরদর করে রক্তাক্ত তোমার স্মৃতি ঝরে পড়ছে আমার পায়ের ছাপে
আমি চলে যাচ্ছি কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে
তাবরিজ, বাকু, এথেন্স, জিব্রাল্টার, মেসিডোনিয়া, ইস্তাম্বুল থেকে ভূমধ্যসাগর

প্রিয় আকাশী
দিনশেষে আমি তোমার কাছে ফিরে আসি
অথচ প্রতিটি প্রহর, প্রতিটি মুহূর্ত আমি তোমার সঙ্গেই ছিলাম
আমার ফিরে যাবার কোনো ঠিকানা নেই
আমার সকল গন্তব্য এসে মিশেছে তোমার আলিঙ্গনে