মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, আমি জঙ্গে সিফফিনের বর্শায় গাঁথা সেই এক জিলদ কুরআন হয়ে যাই। হজরত মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনী রক্তাক্ত যুদ্ধের ময়দানে যে কুরআনকে বর্শায় বেঁধে সুউচ্চে তুলে ধরে বলেছিলো, ‘আর যুদ্ধ চাই না। আমাদের মাঝে ন্যায়ের ফয়সালা করবে এই কুরআন।’

আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনী কুরআনের সম্মানে সেদিনই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। দু পক্ষেই নিহত হয়েছিলেন ৬৫ হাজার মুসলিম। আলি রা.-এর পক্ষে ২৫ হাজার, মুআবিয়া রা.-এর পক্ষে ৪০ হাজার। সবাই ছিলেন মুসলিম। ছিলেন অসংখ্য সাহাবি। ইসলামি ইতিহাসের সবচে বেদনাবহ এ যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল সেই বর্শায় গাঁথা কুরআনের বদৌলতে। 

আমার ইচ্ছা হয়, আমিও বর্শাবিদ্ধ সেই কুরআন হয়ে যাই। টঙ্গী ইজতেমার ময়দানে কেউ আমার বর্শাবিদ্ধ দেহ উঁচু করে ধরে বলুক-‘আমান…আমান…শান্তি চাই…শান্তি চাই…!’ 

দুই
মুসলিম-মুসলিম সহিংস সংঘর্ষ হচ্ছে আমাদের দেশে। তবু এমন মুসলিমদের মধ্যে, যারা ৯০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত কাঁধে করে বয়ে বেড়িয়েছেন। তাদের অক্লান্ত শ্রম-ঘাম-মূল্যে পৃথিবীর এমন এমন স্থানে কালেমার দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে, যেখানের মানুষ কোনোদিন ইসলামের নামও শোনেনি। মসজিদ থেকে শুরু করে মদের জলসা, রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, তারকাব্যক্তি সবাই বুক পেতে গ্রহণ করেছেন তাদের নবিওয়ালা কাজ। 

তারা এক দস্তরখানে এক প্লেটে বসে খেয়েছেন। তারা এক কাতারবন্দী হয়ে গাশতে গিয়েছেন। নেশায় মত্ত যুবক, অপরাধে লীন হওয়া তরুণ, পাপে বিদগ্ধ ব্যক্তিকে তারা একসঙ্গে তাশকিল করে মসজিদের বারান্দায় নিয়ে এসেছেন। একদিন সেইসব অপরাধী যুবকরাই পিঠে-কাঁধে করে গাট্টি আর ডেকচির বোঝা বয়ে নিয়ে গেছেন মাইলের পর মাইল। এটাই তাবলিগ। এভাবেই পৃথিবীর প্রায় ৭ কোটি মানুষ সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছেন তাবলিগের সঙ্গে। 

আজ সেই জামাত দ্বিধাবিভক্ত। শুধু বিভক্ত তাই নয়, তাদের একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আহ! পৃথিবীর কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল। শত শত আলেম-তলাবার শরীরের রক্তে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল তাবলিগের সাদা জায়নামাজ। এ বড় দুঃখের দিন ইসলামের ইতিহাসে।

হিংসা দিয়ে কখনো আপনি হিংসার প্রতিকার করতে পারবেন না, হিংসার সবচে শক্ত জবাব হচ্ছে দাওয়াত। 

আমি অতি ক্ষুদ্রজন, করার তেমন কিছুই নেই আমার সম্বলে। তবু আমার মতো ক্ষুদ্রের পরামর্শ হলো, এখন প্রতিটা গ্রাম, পাড়া-মহল্লার প্রতিটা মসজিদ থেকে বেশি বেশি তিনদিন বা এক চিল্লার জামাত বের করা। ছড়িয়ে পড়ুন সবাই। মসজিদে মসজিদে ধ্বনিত হোক আবার ৬ উসুল। জিকিরে ফিকিরে গাশত হোক। মানুষের দ্বারে দ্বারে আবার রাহবার ভাই কড়া নেড়ে বলুক- ‘ভাই, মসজিদে দ্বীনের ফিকির নিয়ে এক জামাত এসেছে…!’

বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি জনতা শুধু এই কথাটুকু শোনার জন্যই প্রতীক্ষা করছে। তারা তাবলিগের নামে কোনো বিভেদ, কোনো প্রতিহিংসা, কোনো খুন-খারাবির খবর শুনতে চায় না। 

 

তিন

তাবলিগ যখন মসজিদ থেকে মসজিদের বাহিরে চলে এসেছে, তখনই এর মধ্যে প্রতিহিংসা এসে আশ্রয় নিয়েছে। মসজিদে জুড়নেওয়ালা কাজ মসজিদেই রাখেন মেরে ভাই। ৯০ বছর ধরে তাবলিগের কাজ চলছে মসজিদে মসজিদে, কখনো বাইরে আসতে হয় নাই। 

মসজিদে মসজিদে গাট্টি নিয়ে চলা মানুষরাই পৃথিবীর ১৯৪টি দেশে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো আন্দোলনই এত মানুষকে একসঙ্গে এক কাজে জুড়তে পারে নাই। প্রায় ৭ কোটি মানুষ নিজের জান-মাল দিয়ে তাবলিগের সঙ্গে জুড়ে আছেন। কখনো তাদের মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও ধর্ণা দিতে হয় নাই। 

মসজিদই তাবলিগের প্রাণ। সেই প্রাণ থেকে তাবলিগকে জুদা করলে কেবল তাবলিগের খোলস থাকবে, দাওয়াত থাকবে না। 

আল্লাহু খায়রুল হাফিজিন!

 

চার

আজ যারা তাবলিগের নামে সংবাদমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, এদের ৯০ ভাগই কোনোভাবে তাবলিগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাবলিগের দুর্দিনে আজ তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যক্তিগত ক্ষোভ-তাচ্ছিল্য-প্রতিহিংসা সব ঢেলে দিচ্ছেন। 

মনে রাখবেন, দুই মুসলমানের ঝগড়ার সময় যে ব্যক্তি ঝগড়া না মিটিয়ে বরং আরও উস্কে দেয়, সে কখনো কোনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না।