যাদের গায়ের রং কালো বা দেখতে খানিকটা আনস্মার্ট তারা মনে করে, সুন্দর আর স্মার্ট ছেলে/মেয়েদের তো কোনো দুঃখ নেই, তাদের সব আছে, সবদিক থেকে তারা হ্যাপি। আবার সুন্দররা ভাবে, কালো-আনস্মার্টরাই সুখী। ওদের খুব বেশি এক্সপেকটেশন নেই, জীবনে চাওয়া-পাওয়ার তেমন ব্যাপার নেই। গরিবরা বড় বড় দালান দেখে ভাবে, ধনীদের কোনো অসুখ নেই, তারা সবদিক থেকে সুখী। আবার পয়সাওয়ালারা গরিবের ভাঙা কুটিরের দিকে তাকিয়ে ভাবে, আহা! আমার যদি অমন একটা নিশ্চিন্ত ডেরা থাকত!
রবীন্দ্রনাথের দুটি পঙক্তি আছে এ ব্যাপারে—
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
পৃথিবীতে কেউ সুখী নয় বস্তুত। আমরা সবাই অসুখী। সমাজের একেবারে উঁচুতলা থেকে শুরু করে নিঃস্ব ব্যক্তিটির দুঃখ সমান। দুঃখ-কষ্ট আমাদের চারপাশ বেষ্টন করে আছে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই দুঃখ-কষ্টকে আপনি কীভাবে দেখছেন। এসব মানসিক কষ্টের মুখোমুখি কীভাবে হচ্ছেন আপনি, সেটা দিয়েই পরিমাপ করা যাবে আপনার দুঃখ কত গভীর।
আপনি আপনার মানসিক কষ্ট ও ডিপ্রেশনকে যেভাবে ফেস করবেন সেগুলো আপনার সামনে সেভাবেই উপস্থাপিত হবে। আপনি যদি মানসিক ডিপ্রেশনকে মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মেনে নিয়ে আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যান, দুঃখ আপনাকে সহজে কাবু করতে পারবে না। নদীতে ঢেউ আসেই, আপনি ঢেউটি চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ঢেউ কখনোই স্থায়ী কোনো বিষয় নয়, দুঃখ-কষ্ট তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী হবে যদি আপনি কষ্টের মুখোমুখি হওয়াকে ভয় না পান। প্রতিদিন কষ্টের মুখোমুখি হোন এবং প্রতিদিন সেগুলোকে হেলায় পাশ কাটিয়ে যান।
গৌতম বুদ্ধ দুঃখকে দেখেছেন এভাবে—‘জগতে সুখ ও দুঃখ উভয়েরই অস্তিত্ব বর্তমান, কিন্তু তিনি এই শিক্ষাও দেন যে, সুখ কখনোই চিরস্থায়ী নয় বরং তা সর্বদা পরিবর্তনশীল। সুখের এই পরিবর্তনশীল চরিত্রের জন্যই জীবনে চাহিদার পূরণ হয় না এবং দুঃখের সৃষ্টি হয়। সেই কারণে এই সত্য না জানা পর্যন্ত জীবের দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।’
দুই
ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ, হতাশা থেকে বাঁচতে সবচে সহজ কাজ হলো আপনার কষ্ট–দুঃখ–দুশ্চিন্তা অপরের কাছে শেয়ার করা। না, কোনো সংকোচ করবেন না। দুনিয়ার সব মানুষের দুঃখ আছে, নানা রকম দুঃখ, গভীর গভীর দুঃখ। সুতরাং দুঃখ-কষ্ট নিয়ে অপরের কাছে প্রকাশ করতে কখনোই সংকোচ করবেন না। শেয়ার করুন, যা আছে মনে। প্রয়োজন হলে অপরিচিত কারো কাছে বলুন। তবু বলুন, নিজেকে কখনো মানুষের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। বলতে না পারলে লিখুন। তবু প্রকাশ করুন। মনের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট স্তূপ করে রাখবেন না। দুঃখ যত জমিয়ে রাখবেন সেগুলো আপনার ভেতরে নতুন নতুন কোষ তৈরি করবে, ভাইরাসের মতো। তাই দুঃখগুলো মন থেকে উজাড় করে অন্যের কাছে বলে দিন।
আরেকটি ভালো উপায় হলো বেরিয়ে পড়া। মানে, যেখানে আপনি আছেন সেখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাওয়া, একা কিংবা কয়েকজন। প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও যেতে পারেন, কিংবা যেতে পারেন যেখানে মানুষের খুব কোলাহল। আল্লাহর সৃষ্টি অনন্ত প্রকৃতির মাঝে নিজেকে যেমন নতুন করে চেনা যায়, তেমনি পাওয়া যায় আত্মিক শক্তি। আত্মিক শক্তির অভাবই আমাদের যাবতীয় ডিপ্রেশনের মূল কারণ। নিজের ভেতরে আরেকজন শক্তিশালী বান্দা যে ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগ্রত করার কোশেশ করুন। আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান সেই বান্দাটা আপনার ডিপ্রেশনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। পার্থিব দুঃখ-কষ্টকে সে থোড়াই কেয়ার করে।
মানুষের কোলাহলে গিয়ে দেখবেন, কত সহস্র মানুষ স্রোতের মতো জীবনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আপনি তাদেরই একজন। জীবনের জয়গান ওখানে। আপনি তাদের থেকে নিজেকে কেন বিচ্ছিন্ন করে রাখবেন? সবার সঙ্গে হাঁটুন। হেঁটে হেঁটে চলে যান বহুদূর, মানুষের পাশাপাশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব শিগগির মানসিক ডিপ্রেশন মহামারী আকার ধারণ করবে। বিশেষত অমরা অধিক হারে অনলাইনকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এই ডিপ্রেশন হু হু করে বাড়ছে। অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস আমাদেরকে পরিবার ও বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস আগের চেয়ে কমিয়ে দিন। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করুন। কোনো হতাশা দেখা দিলে, কোনো কষ্ট এলে কথা বলুন বান্ধবদের সঙ্গে, প্রিয়জনের সঙ্গে। দুঃখই জীবনের শেষকথা নয়। হয়তো আরেকটি সুখের শুরু মাত্র।
তিন
মানুষ দুঃখ কেন পায়? মানুষ মূলত দুঃখ পায় অপ্রাপ্তির জন্য, তার চাওয়া পূরণ না হবার কারণে। একজন মানুষ টাকা-পয়সার কামনা করে পেল না, সে দুঃখ পাবে। কেউ ভালোবাসা চেয়ে পেল না, তার দুঃখ লাগবে। কেউ সন্তান কামনা করে পেল না, তার দুঃখ হবে। আবার একজন মানুষের কাছে আমরা যেটা কামনা করি, তার থেকে কাঙ্ক্ষিত বিষয় না পেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের সামনাসামনি হলেও আমরা দুঃখিত হই—তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। যে ঘটনা ঘটার কথা নয়, যে ঘটনা আমরা চাই না ঘটুক, এমন ঘটনার সম্মুখীন হলে আমরা দুঃখিত হই।
এই যে আশা করা, কামনা করা, মনেপ্রাণে কোনো কিছু চাওয়া—এসবের অপ্রাপ্তিই মানুষের মনে দুঃখ ফেনিয়ে তোলে। এ অপ্রাপ্তি কখনো কান্না হয়ে প্রকাশ হয়, কখনো ক্ষোভ-জিঘাংসা, হতাশা, অবিশ্বাস হয়ে প্রকাশ পায়।
সব মানুষের প্রকাশভঙ্গি যেমন এক নয়, সকলের সহ্যক্ষমতাও সমান নয়। আমরা কাঁদি, হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি, অপ্রকৃতস্থ আচরণ করি, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাই। মানুষের মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রকাশ একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। সহ্যের সীমার বাইরে গেলে অনেকে আত্মহননের পথও বেছে নেয়। সকলের মানসিক দৃঢ়তা যেমন এক নয়, তেমনি সবার দুঃখ প্রকাশ করার কায়দা-কানুনও একরকম নয়। এ কারণেই আমরা একই দুঃখের নানাধর্মী প্রকাশভঙ্গি দেখতে পাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।
কিন্তু আমরা কি আমাদের দুঃখের বোঝাকে খানিকটা লাঘব করতে পারি? আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, আমরা কি আমাদের দুঃখের লাগামটা নিজেদের হাতে নিতে পারি না? যখন দুঃখ আসবে, আমরা সহজেই সে দুঃখের ভারটা লাগাম টেনে নিজেদের ইচ্ছেমতো কমিয়ে ফেলতে পারি কি-না, এটাই হলো কাজের কথা।
চার
তো, বিষয়টা কিন্তু খুবই সিম্পল; যদি সত্যিকারার্থে দুঃখকে জয় করার সদিচ্ছা আমাদের থাকে। মানে, দুঃখকে জয় করে সুখী হওয়ার পদ্ধতি একেবারেই সহজ। কীভাবে? সুখী হতে হলে আপনাকে প্রাপ্তির তালিকাটা ছেঁটে ফেলতে হবে। অনেক অর্থ কামানোর স্বপ্ন, সুন্দর একটা বাড়ি, বাড়িতে সুন্দরী বউ এবং গোটা কয়েক বাচ্চা, ঘরভর্তি সাজানো দামি আসবাব, সমাজে সুখ্যাতি, ব্যাংকে জমানো ব্যালেন্স, দেখতে সুন্দর/সুন্দরী হ্যান্ডসাম হওয়া…! এই যে আমাদের কামনার দীর্ঘ তালিকা, এই তালিকাই আমাদের সকল কষ্টের মূল। আমাদের অনিঃশেষ চাওয়ার যে ব্যাপ্তি, এই ব্যাপ্তিই দিনশেষে আমাদের মনের মধ্যে নানাধর্মী দুঃখ গুঁজে দেয়।
এখন আপনাকে যা করতে হবে, এই তালিকাটা মনের এমন একটা ফোল্ডারে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে যেটা সাধারণত আপনার নজরে কখনো পড়বে না। আপনার স্বপ্ন থাকবে ঠিকই, তবে সেটা আপনার বাস্তবতাকে কখনো পেরিয়ে করবে না। অনেক বড় হওয়ার মানসিক দৃঢ়তা অবশ্যই রাখবেন, কিন্তু সেটার অপ্রাপ্তি যেন আপনাকে দুমড়ে মুচড়ে না ফেলে—সে ব্যাপারে শুরুতেই একটা প্রতিচিন্তা মনের মধ্যে প্রস্তুত করে রাখুন। অর্থ-খ্যাতি-অভীপ্সা থাকতেই পারে, কিন্তু সেটাকেই জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান করার প্রহসন থেকে সরে আসতে হবে।
এই পৃথিবীতে যার চাওয়ার তালিকা যত ছোট, যত নগণ্য; তার সুখী হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। দিনশেষে একটু সুখনিদ্রা কে না চায়? কিন্তু মনের ভেতরে একগাদা অপ্রাপ্তি নিয়ে কি আপনি সুখে ঘুমোতে পারবেন? আপনার চাওয়ার তালিকাটা যদি ছোট হতো—ছোট্ট একটা ঘর, স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা নিয়ে তিনবেলা ডাল-ভাত খাওয়ার সামান্য আয়োজন, ছোট একটা চাকরি কিংবা ছোট একটা ব্যবসা, চলে যাবে দিন। দেখবেন, কী সুখেই না আপনি ঘুমোতে পারছেন! আটপৌড়ে জীবন দেখে লোকে হয়তো খাটো চোখে দেখবে, বাড়িতে ছাদওয়ালা বাড়ি না থাকায় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা আহা উহু করবে; কিন্তু সত্যিকারের সুখটা তো আপনি যাপন করছেন। এ সুখের নাগাল তারা পাবে কোত্থেকে?
এখানে ইসলামের সন্নিবেশটা চমৎকার। ইসলাম বলছে—তোমার এ নশ্বর পৃথিবী কিছুই না। অঢেল ধন-সম্পদ, প্রেম-ভালোবাসা, সন্তান-সন্ততি সবকিছু একদিন তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে। পরকালে তোমার ধন-সম্পদ নয়, গণ্য করা হবে তোমার সৎকর্ম। সুন্দর চেহারা আর লেবাস-পোশাক নয়, পরখ করা হবে তোমার চারিত্রিক সৌকর্য। হাজারো জনের স্তুতি কোনো কাজের কাজ নয়, আত্মিক পরিশুদ্ধতাই হবে তোমার পারলৌকিক প্রধান পরিচয়।
পরকালীন জীবনের সঙ্গে ইহকালীন জীবনকে সংযুক্ত করার এই প্রাণান্ত প্রয়াসই ইসলামের মূলমন্ত্র। এ কারণেই ইসলামের আবেদন কখনো ফুরিয়ে যাবার নয়। ইসলাম বস্তু নয়, জয়গান গেয়েছে মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধতার। যে মানুষ যত বেশি আত্মিক বলে বলীয়ান, দুঃখকে জয় করার শক্তি তার তত বেশি, সে নিজের দুঃখকে তত বেশি লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা রাখে। পরকালে আল্লাহর সামনে মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যার মনে সঞ্জীবিত হবে, তার কাছে স্বাভাবিকভাবেই দুনিয়ার সকল কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া তুচ্ছ হতে বাধ্য।