আধুনিক মুসলিম নারীবাদীরা উম্মে দারদাকে (রহ.) খুব সমীহ করে। অনেকে তাকে মুসলিম নারীবাদের প্রথম প্রবক্তাও মনে করে। একজন তাবেয়ি হিসেবে পুরুষ স্কলারদের পাশাপাশি দামেশকের উমাইয়া মসজিদে দরস প্রদান—কম কথা তো নয়। এখনকার সময়েই তো মুসলিম নারীরা এমন সাহস করেন না। আর ঠিক নবীজির ইন্তেকালের মাত্র কিছুদিন পর তিনি উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী দামেশকে বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের কুরআন-হাদিসের দরস দিতেন, তিনি তো অবশ্যই আইডল হওয়ার যোগ্য!
যার যেমন ইচ্ছা। যেমন কম্যুনিস্টরা আবু জর গিফারিকে (রা.) মনে করে সমাজতন্ত্রের আদি উৎস। ইসলাম মান্য করুক বা না করুক, আবু জর গিফারিকে তারা খুব মান্য করে থাকে। বাংলাদেশে আর কোনো সাহাবির নামে কোনো কলেজ আছে কিনা জানি না, তবে ঢাকা শহরে আবু জর গিফারির নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
যাক, উম্মে দারদার পরিচয় এবং কেন তাকে আধুনিক মুসলিম নারীবাদীরা নিজেদের আইডল মানে, সে ব্যাপারে খুচরা কিছু আলাপ করি।
১.
উম্মে দারদার (রহ.) মা-বাবা কে ছিলেন, সে ব্যাপারে ইতিহাস নিরব। তবে ছোটবেলায়ই তিনি মা-বাবাকে হারান। এতিম শিশু হিসেবে সাহাবি আবু দারদা (রা.) তার লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন এবং পরিণত বয়সে তাকে বিয়ে করেন।
ইবনে জাবির এবং উসমান ইবনে আবু আতিকাহ বলেন, ‘অল্প বয়সে যখন উম্মে দারদা এতিম হয়ে যান, আবু দারদা স্নেহ ও মমতাভরে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। মেয়েটি সবসময় আবু দারদার সঙ্গে থাকত। তিনি যখন নামাজ পড়তে যেতেন, সে তার সঙ্গে পুরুষদের কাতারে নামাজ পড়ত। মসজিদে ছেলেদের সঙ্গে বসে কুরআন পড়া শিখত এবং কুরআন মুখস্থ করত। তবে সে যখন বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠে, একদিন মসজিদে গিয়ে আবু দারদা তাকে বলেন, “এখন থেকে তুমি ওই পাশে নারীদের কাতারে গিয়ে নামাজ পড়বে।” (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৮)
আবু দারদা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) সময়কালে মদিনা থেকে দামেশকে চলে যান। তিনি স্বেচ্ছায় এ প্রবাস জীবন বেছে নেন। যাওয়ার আগে খলিফার কাছে দামেশকে যাওয়ার অনুমতি চাইলে খলিফা উমর তাকে বললেন, ‘তুমি যদি দামেশকে যেতেই চাও তবে রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব নিয়ে যাও।’
আবু দারদা বললেন, ‘শাসক হওয়া আমার পছন্দ নয়।’
খলিফা রাগ করে বললেন, ‘তাহলে আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। তুমি তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী যেখানে খুশি যেতে পারো।’
নিরুপায় হয়ে আবু দারদা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি সেখানে মানুষকে কুরআন ও হাদিস শেখাব এবং তাদের নামাজ পড়া শেখাব।’
তার উত্তরে খুশি হয়ে খলিফা তাকে দামেশকে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ ও হায়াতুস সাহাবা সূত্রে মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ প্রণীত আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, ৩/২০৫)
মদিনায় থাকাকালীন আবু দারদা (রা.) উম্মে দারদাকে এতিম শিশু হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাকে সঙ্গে করে দামেশকে নিয়ে যান। পরিণত বয়স হলে তাকে বিয়ে করেন। আবু দারদা দামেশকের উমাইয়া মসজিদে প্রতিদিন শত শত শিশু-কিশোরকে কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা দিতেন। উম্মে দারদা এখানেই তার ইসলামি জ্ঞানের পরিপক্কতা লাভ করেন। আয়েশা (রা.) ও সালমান ফারসি (রা.) থেকে তিনি হাদিস সংগ্রহ ও রপ্ত করেছিলেন। এছাড়াও তৎকালীন দামেশকে অবস্থানরত একাধিক সাহাবি থেকে তিনি হাদিস শোনেন।
২.
আবু দারদার প্রতি উম্মে দারদার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। আবু দারদা যখন মারা যান তখন উম্মে দারদার বয়স খুব বেশি ছিল না। আবু দারদার মৃত্যুশয্যায় তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘আমি পরকালে তোমাকে কেবল নিজের জন্য রাখতে চাই।’
আবু দারদার মৃত্যুর পর মুআবিয়া (রা.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুআবিয়া তখন দামেশকের প্রশাসক। কিন্তু উম্মে দারদা তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলললেন, ‘তোমার চেয়ে আমি বরং রোজা রাখাকে প্রাধান্য দেব।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৮)
৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে আবু দারদার মৃত্যুর পর তিনি নিজেও উমাইয়া মসজিদে দামেশকের শিশু-কিশোরদের শিক্ষা প্রদান শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রতাপশালী উমাইয়া খলিফা হওয়া আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানও ছিল তার ছাত্র।
অনেক সময় পড়াতে পড়াতে তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। একদিন তার এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা কি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছো? আরে না! আমি অনেকভাবে আল্লাহর ইবাদত করেছি। কিন্তু আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে ইলম আদান-প্রদানের চেয়ে প্রশান্তিময় স্বাদ আর কিছুতে পাইনি।’
ইমাম বুখারি (রহ.) তার সহিস বুখারি গ্রন্থে উম্মে দারদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘উম্মে দারদা ছিলেন একজন অভিজ্ঞ হাদিসবেত্তা।’ ইবনে আবদুল বার তাকে ‘নারীদের মধ্যে হাদিস বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ পণ্ডিত এবং ধর্মতত্ত্ববিদ। একই সাথে অত্যন্ত ধার্মিক ও ইবাদতগুজার’ বলে অভিহিত করেছেন।
উম্মে দারদা দামেশকের উমাইয়া মসজিদ এবং ফিলিস্তিনের জেরুজালেম—দুই স্থানে ইসলামি জ্ঞানের দরস প্রদান করতেন। তিনি দরস প্রদানের বিনিময়ে কোনো পারিতোষিক গ্রহণ করতেন না। তিনি দানশীল নারী ছিলেন কিন্তু অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। ইবনে আসাকির তারিখে দিমাশক গ্রন্থে লিখেছেন, উম্মে দারদা একবার জেরুজালেমে কয়েকজন দরিদ্র মহিলার সঙ্গে বসে ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাকে একটি রুপার দিরহাম দান করে গেল। তিনি দিরহামটি তার খাদেমের হাতে দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে উটের গোশত কিনে আনো। খাদেমা জিজ্ঞেস করল, এটা তো সদকার দিরহাম! এটা আপনি কিভাবে গ্রহণ করবেন? তিনি উত্তর দিলেন, যেহেতু এটা আমি না চাইতেই আমাকে দেয়া হয়েছে, সুতরাং এটা দান নয়।
আগে যেমনটা বলেছি, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ছিলেন তার একান্ত ছাত্র। আবদুল মালিক নিজেও হাদিসের অনেক বড় ইমাম ছিলেন। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তাকে যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম বলে অভিহিত করেছিলেন। আবদুল মালিক খলিফা হওয়ার পরও অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উম্মে দারদার দরসে উপস্থিত হতেন।
খলিফা আবদুল মালিক অনেক সময় তার শিক্ষাগুরু উম্মে দারদাকে দাওয়াত করে নিজ প্রাসাদে নিয়ে যেতেন। এমন এক রাতে খলিফা শেষ রাতে জেগে তার দাসীকে ডাকলেন। দাসীর আসতে কিছুটা দেরি হলে তিনি তাকে বকাঝকা করলেন ও অভিশাপজনিত কিছু বাক্য বললেন। উম্মে দারদা তার এমন কথা শুনে খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অভিশাপ দিয়ো না। আমি আবু দারদাকে বলতে শুনেছি, তিনি নবীজি (সা.) থেকে শুনেছেন, “যারা অভিশাপ দেয়, কেয়ামতের দিন তাদের কোনো সাক্ষী বা সুপারিশকারী থাকবে না।”
৩.
তিনি সাহাবি ছিলেন কি-না, এ ব্যাপারটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। একদল গবেষকের মতে, সাহাবি আবু দারদার (রা.) দুজন স্ত্রী ছিল, দুজনকেই আবু দারদার মেয়ে ‘দারদা’র নামানুসারে উম্মে দারদা বলে ডাকা হতো। একজনকে ডাকা হতো উম্মে দারদা কুবরা এবং অপরজন উম্মে দারদা সুগরা। উম্মে দারদা কুবরার মূল নাম ছিল খায়রা বিনেত আবু হাদরাদ। তিনি সাহাবি ছিলেন, এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। উম্মে দারদা সুগরা নামে যিনি পরিচিত এবং যার ব্যাপারে এতক্ষণ আলোচনা করা হলো, তার নাম হুজাইমাহ আল আওয়াসাবিয়্যাহ। তিনি সাহাবি নন বলেই অধিকাংশের মতামত।
তবে কোনো কোনো ইমাম দুজন নয়, বরং একজন উম্মে দারদার নাম উল্লেখ করেন এবং দুজনকে একই ব্যক্তি বলে অভিহিত করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৭)
ড. আকরাম নদভি তার ‘আল-মুহাদ্দিসাত’ গ্রন্থে উম্মে দারদার আলোচনা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন।
উম্মে দারদা ছেলে ও মেয়ে—উভয় শ্রেণির দরসে দরস প্রদান করতেন ও ধর্মীয় বক্তৃতা দিতেন। এটিকে মুসলিম নারীবাদীরা তাদের দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন। উম্মে দারদা পরিণত বয়সের ছেলেদের দরসে লেকচার প্রদান করতেন কি-না, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো দলিল পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে পুরুষ স্কলারদের পাশাপাশি সময়ে উমাইয়া মসজিদে ও জেরুজালেম মসজিদে দরস প্রদান করতেন, এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
আল্লাহই ভালো জানেন…!