বিকেলে দক্ষিণ বিলের পাশে পুকুর থেকে হাঁস আনতে গিয়েছিলাম। সেজো চাচার বাড়ির লাগোয়া পুকুর, আকারে খুব একটা বড় না। বর্ষা মৌসুমে ছোট ছেলেপিলে দাপাদাপি করে, ঘণ্টাখানেক ডুবিয়ে মায়ের হম্বি তম্বি শোনার আগে আর উঠে না। এখন পুকুরে টলটলে জল থাকলেও পুকুরভরা কলমি লতা ছেয়ে আছে। লতার ডগা ছাপিয়ে ফুটে আছে শত শত কলমি ফুল। গায়ের রঙ সাদা-বেগুনি। পুরোটা পুকুরজুড়ে দপদপ করছে সাদা-বেগুনি ফুলের রোশনাই। গাঢ় সবুজ পাতা আর হালকা খয়েরি রঙের ডাঁটার কাঁধে ভর করে ফোটা ফুলগুলো যেন কাজীর বানানো বইয়ের প্রচ্ছদ। পুকুরের টলটলে জল আলাদা একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অবজেক্ট ঠিক দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এখন দক্ষিণ পাড়ের কলা গাছগুলোর নিচে বইয়ের নাম আর লেখকের নামটা বসিয়ে দিলেই হয়!
নচ্ছার হাঁসগুলো পুকুরের মাঝে হলুদ ঠোঁট দিয়ে পাখনা খুঁটছিলো। গুনতিতে চারটি। আমাকে আসতে দেখে গর্দান উঁচিয়ে একবার দেখে নিয়ে নিজের কাজে ফের মশগুল হয়ে গেলো, আচরণে খুব একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। গৃহস্থ হিসেবে বাড়িতে আমাকে খুব একটা গোনায় ধরে না ওরা। মা-ই ওদের একনিষ্ঠ গৃহস্থ, তাঁকেই মান্য করে যা। সকালে খোঁয়াড় খুলে দেয়া, ডিম আনা কিংবা সন্ধ্যায় তই তই করে পুকুর থেকে ডেকে নিয়ে আসার মধ্যে মা’র সঙ্গে ওদের যে সাইকোলোজিক্যাল বোঝাপড়া, আমার সঙ্গে সেটা নিতান্ত কম। ফান্দে পড়ে গেছি, মা সপ্তাহখানেক ধরে বাড়ি নেই। মা’র অনুপস্থিতিতে পাশের বাড়ির মেজো চাচি কিছুটা তদারক করেন। সকালে খোঁয়াড় খুলে দেয়া আর ডিম আনার মহান কর্মটি আমার দ্বারা হলেও সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে বাঁসি ভাত আর খুদ-কুড়ো দেয়ার কাজটি সহধর্মিণী করে থাকেন। তাই হাঁসগুলোর সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব রয়েই গেছে।
দক্ষিণ পাশের বিল সংলগ্ন এ পুকুরটি হাঁস চতুষ্টয়ের নির্দিষ্ট বিচরণ ক্ষেত্র নয়। ওদের বিচরণের অভয়ারণ্য হচ্ছে আমাদের বাড়ির পেছনের বিশাল পুকুর। কিন্তু দীর্ঘদিন ওই পুকুরে চরে বেড়ানোতে সম্ভবত ওদের একটা বিতৃষ্ণার মতো হয়ে গেছে। সকালবেলা হই হই করে বাড়ির পেছনের পুকুরে তাড়িয়ে দিলেও, দিনের কোনো এক সময় ওরা চুপিসারে বাড়ি টপকে, রাস্তা পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ বিলের পুকুরে নেমে যায়। কিন্তু দক্ষিণ বিল হাঁসদের জন্য নিষিদ্ধ গন্ধম। কেননা বিলে হর-হামেশা হয় ধানের আবাদ। কখনো ইরি, কখনো আমন, কখনোবা ধানের বীজতলা তৈরি করে ধান ফেলা হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। সেসব ক্ষেতে গেলে সব্বোনাশের অন্ত নেই। নরম বীজতলা হাঁসের চ্যাপ্টা পায়ের তলায় পড়ে যারপরনাই থেতলে যায়। তাছাড়া ধানক্ষেতে গেলে তো আরও সমস্যা, ক্ষেতের ভেতর গিয়ে হাঁসগুলো লম্বা ঠোঁট দিয়ে ধানের ছড়াটা কোঁৎ করে গিলে ফেলে, কোনো বাছ-বিচার নেই। ক্ষেতের মালিক একবার দেখে ফেললে হাঁসের গর্দান ধরে টান দিয়ে নিয়ে যাবে নিরুদ্দেশে। কিংবা চোখ রাঙানি আর দু কথা শোনানোর ঝক্কি তো রয়েই গেলো। এ কারণে মা-চাচি তক্কে তক্কে থাকেন।
সে হিসেবে আমার তক্ক অত্যন্ত নিম্ন মানের। কিন্তু আজকে নিম্ন মানের তক্ক নিয়েই হাঁসের খোঁজে আসতে হয়েছে। বাড়িতে চাচির ম্যালা কাজ। দুজন কামলা নিয়ে ধান কাটানো হয়েছে, কামলাদের সামলানোয় ব্যস্ত। আবার সামনের টিনের বাংলাঘরটা ভেঙে ফেলার জন্য দুজন কাঠমিস্ত্রি সকাল থেকেই যাগযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিকেল বিকেলে ঘরের চারপাশের টিন তো বটেই, উপরের চালও নামিয়ে ফেলেছে তারা। বাড়িটা কেমন উদোম উদোম লাগছে এখন। দাদার আমলের বাংলাঘরটা পুরোনো মরচেপড়া টিনের বেড়ার ফাঁক-ফোকরে বহু পুরোনো স্মৃতি নিয়ে ধুঁকছিলো এতোদিন। আজ জংধরা টিনের সঙ্গে স্মৃতিও নেমে গেলো মাটির চাতালে। পেছনে চাচাতো ভাইয়েরা দোতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একতলা দালান তুলে ফেলেছে। সামনের বাংলাঘরটা যাচ্ছেতাই বেমানান লাগছিলো। কিন্তু বাংলাঘরের টিনের বেড়া নেমে যেতেই পাশে আমাদের বাড়িটাও কেমন একটু বেআব্রু হয়ে গেছে। বেশ খানিকটা দূর দিয়ে যাওয়া সড়ক থেকে পথচারীরা ঘন দৃষ্টিতে তাকালে একতলার বারান্দাটা মুশকিলে দেখতে পারবে। যদিও একটা আম্রপালী আমগাছ বারান্দাকে খানিকটা আব্রু দেয়ার কাজ করছে, কিন্তু ও দিয়ে তো আর পর্দা-পুশিদা হবে না। দু-এক দিনে একটা আউলি-বেড়া না দিলেই নয়। এ নিয়েই কথা বলছিলাম বউয়ের সঙ্গে। এমন সময় চাচি বললেন দক্ষিণের বিল খুঁজে হাঁস নিয়ে আসতে।
মাঝ পুকুরে হাঁস মানে হাতের নিশানা ঠিকঠাক রাখতে হবে। পুকুর পাড়ের ক্ষেত থেকে মাটির ঢেলা তুলে হাঁস চতুষ্টয়ের পেছন বরাবর ছুঁড়ে মারলাম। বেশ বাজে নিশানা। হাঁসগুলো আমার গেরস্থভাব পছন্দ না করলেও একটা ম্যাসেজ তাদের পৌঁছানো গেলো- আমার বেলা যে যায়! একটু এগিয়ে গাঁই গুঁই করে আবার সাঁতার থামিয়ে দিলো। অগত্যা আমাকে পালাক্রমে ঢেলার কামান দাগাতে হলো। হাঁসগুলো এক প্রকার বিতৃষ্ণ হয়েই পাড়ের দিকে যাত্রা করলো। পুকুরের পাড় থেকে একবার ডাঙায় উঠে এলে আর ব্যাত্যয় হয় না, হাঁসেরা ঠিক জানে তাদের যাত্রাপথ। একদম এক রাস্তায় চলে আসবে খোঁয়াড়ের কাছে। এ ব্যাপারে মুরগির চাইতে হাঁসের মুন্সিয়ানা প্রশংসাযোগ্য। দুই পাশে হেলে দুলে হেঁটে হেঁটে তারা ঠিক গেরস্থবাড়ি চলে আসে। পথিক, তুমি পথ হারাও নাই!
আমি হেলতে দুলতে থাকা হাঁসদের পেছন পেছন বাড়ির পথ ধরলাম। বিকেলের কিছু সময় হাঁস আর কলমি ফুলের সঙ্গে, কোথাও কি বাংলার অভিমানী কবি জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যা করেছেন আজ?
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে