আফগানিস্তানের পুরুষেরা জুব্বা পরে না। তারা কাবলি পরে। পশ্চিমা শিক্ষিত দু-একজন হয়তো স্যুট-কোট পরে, কিন্তু মোটা দাগে সকল আফগানের প্রধান পোশাক কাবলি।

আফগানিস্তানের ধর্মীয় শ্রেণিকে দেখুন—বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান, তালেবানকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মাদরাসার শাইখুল হাদিস থেকে শুরু করে আজিজ তলাবা, তালেবান আন্দোলনের লোকসকল—সকলেই কাবলি পরে। সঙ্গে আফগানী টুপি এবং কালো বা সাদা পাগড়ী। এরা জুব্বা পরে আরব হতে চায় না, আবার লাল বা সাদা রংয়ের রুমাল মাথায় দিয়ে আরবী শাইখদের মতোও হতে চায় না। পশতুন, পাঠান, হাজারা বা তাজিক—যে কোনো আফগান জনগোষ্ঠীর পোশাক একই রকম। তাদের মাঝে জাতিগত ভিন্নতা থাকতে পারে, ভাষার ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু পোশাকের সংস্কৃতিতে তারা সকলেই আফগান সংস্কৃতির ধারক বাহক। নিজ দেশের সংস্কৃতির ওপর এরা অন্য কোনো সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেনি। তাদের নিজস্ব পোশাকই তাদের জাতিসত্তার পরিচয়, তাদের পরিচিতির অন্যতম সিম্বল।

আবার আরবরা কখনোই কাবলি বা পাঞ্জাবি পরে না। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি জুব্বাতে তারা সাবেত কদম।

আমাদের দেশের ধর্মীয় শ্রেণির দিকে নজর দেয়া যাক। এদের নিজস্ব কোনো সংস্কৃতি নেই। এরা জানেই না যে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতিতে পুরুষের পোশাক কী! একদল জুব্বা পরে, কারণ আরবরা জুব্বা পরে; সুতরাং জুব্বা সবচে বড় সুন্নত। একদল সেমি-জুব্বা পরে, বরিশাল-ঝালকাঠি অঞ্চলের এরা। আরেকদল সেমি-জুব্বার দুই পাশে ছয় ইঞ্চির মতো কাটা রাখে, এরা তাবলিগের ছয় নম্বরওয়ালা। পাঞ্জাবি পরে বৃহৎ একদল ধর্মীয় শ্রেণি, কারণ এটা পরতে, খুলতে, আস্তিন তুলে বসতে তুলনামূলক আরাম ও সহজসাধ্য।

টুপির ক্ষেত্রেও বহুধা বিভক্তি। পাঁচ কল্লি, কিস্তি, খাপড়া, সুতার টুপি এবং আরও নানা তরিকার টুপি দেদার চলে আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে। কিন্তু আমাদের বাঙালি মুসলিম টুপি কোনটা? কোন টুপিটা একই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব বাঙালি ও ইসলামি মূল্যবোধকে উপস্থাপন করে? পাগড়ী আমরা নানা রং ও সাইজের পরি, নিজস্বতা নেই। আমাদের রুমালের রংও বহুবিধ। একেক মাদরাসা, তরিকা, খানকার টুপি, পাগড়ী, রুমাল আলাদা আলাদা। তাহলে আমাদের পোশাক কোনটা? আমরা কি তবে মিশ্র সংস্কৃতির মুসলমান? মিশ্র সংস্কৃতির আলেম-তলাবা?

অনেকে চিন্তা করছেন, তাতে সমস্যা কী? আছে, নানাবিধ সমস্যা আছে। প্রথম ও প্রধান সমস্যা হলো, কালকে আমি আপনাকে ভরা জনসভায় প্রশ্ন করতে পারি, আপনি কে? আপনি তো বাঙালি না। আপনার পোশাক-আশাক, শিল্প-সংস্কৃতির কোথাও তো বাঙালিয়ানার ছাপ নেই। এই দেশে আপনি যাযাবর হয়ে এসেছিলেন, ঔপনিবেশিক তুর্কি-আফগানদের নিয়ে এসেছিলেন আমাদের শাসন করতে। এখন আমরা জেগেছি, আমাদের ভূখণ্ড আমরা ফেরত নিচ্ছি, আপনারা আপনাদের ধার করা মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে বিদায় হোন! আপনি যদি বাঙালি হতেন তবে আপনার বেশ-ভূষা, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকত। কিন্তু আপনার দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনি কোন সংস্কৃতির মানুষ সেটা আপনি নিজেই ঠাহর করতে পারবেন না।

ব্যাপারটা সংক্ষেপে বুঝাতে পারলাম কি-না জানি না, তবে ধার্মিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে যে বাঙালি হতে হবে, এ ব্যাপারে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। আপনি জুব্বা পরলে আশরাফ আর আমি লুঙ্গি পরলে আতরাফ হয়ে যাব, এইসব ছ্যাচড়ামি চিন্তা ছাড়তে হবে। আমি বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি, আমার কাছে এর চেয়ে মূল্যবান জমিন পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। সুতরাং আমাকে এখানকার মাটি ও মানুষের কথাই বলতে হবে, এখানকার সংস্কৃতিকে আমার ধর্মের সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ও অধিকার আমারই। সেটা যদি না পারি তবে শাহবাগীরা তো বলবেই, ‘তুই রাজাকার তুই রাজাকার…’