মাদরাসাকেন্দ্রিক একটি অনুষ্ঠানশেষে এক মাদরাসাশিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাদরাসার ছাত্ররা পড়ালেখা করে কী হতে চায়?’

শিক্ষক বললেন, ‘তারা কিছু হতে চায় না। মায়-বাপে পড়তে দিছে তাই পড়ে। কি আর হইতে চাইবে!’
আরেক শিক্ষককে একই প্রশ্ন করলাম। তিনি ফট করে উত্তর দিলেন, ‘মাদরাসার ছাত্ররা এখন ভাইরাল হইতে চায়। যে কোনো উপায়ে ভাইরাল হওয়াই তাদের মাকসাদ। বক্তা হয়ে, লেখক হয়ে, গজল গেয়ে এবং আরও নানা উপায়ে ভাইরাল হওয়া…।’
যাকগে, আমি অন্য একটা দূরবর্তী বিষয়ে আলাপ করি। আমি যেহেতু বইকেন্দ্রিক মানুষ, প্রতিদিনই নানাধর্মী বইয়ের খোঁজখবর করতে হয়। বাংলাবাজার গেলে, কোনো মেলা বা প্রকাশনীতে গেলে চারপাশে বইয়ের ছড়াছড়ি। বিশেষত ইসলামি প্রকাশনীগুলোর কথাই বলছি। ইদানীং তো প্রচুর বই প্রকাশ হচ্ছে। ইসলামি প্রকাশনীগুলো শত শত বই প্রকাশ করছে প্রতি মাসে। নানা স্বাদের সেসব বই।
কিন্তু দুঃখের বিষয়ই বলতে হবে, এসব বইয়ে নতুন কোনো চিন্তা উঠে আসছে না। খুব গড়পড়তা বাজারকাটতি বই প্রকাশ হচ্ছে ৯৫%। এটা আমার অবজার্ভেশন। বাংলাদেশে ইসলাম, ইসলামি শিক্ষা, ইসলামি সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও ঘটনা নিয়ে গবেষণা, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ইসলামের অবস্থান, বর্তমান আমাদের লৌকিক সমাজের টানাপোড়েন, সমস্যার শেকড়ের অনুসন্ধান, সমাজের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নতুন কোনো চিন্তা-ভাবনার বই প্রকাশ হচ্ছে না।
খুব সস্তাভাবে এবং একচ্ছত্রভাবে সমাজের সমস্যাগুলিকে মোটাদাগে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং সেগুলোর সমাধানও দেয়া হচ্ছে সনাতন উপায়ে। সমাজের সমস্যাগুলোর গভীরতা নিয়ে কোনো কথাই উঠে আসছে না ইসলামি লেখকদের কলমে। সমস্যাগুলো নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা তো নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে ইসলামের উৎসস্থল কওমি মাদরাসাগুলো থেকে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা অত্যন্ত হতাশাজনক। কওমিকেন্দ্রিক লেখকদের নিয়ে যদিও আশাবাদী, কিন্তু বাজারকাটতি মনোভাব এতটাই জেঁকে বসেছে আমাদের মাঝে, বাজারের বাইরে গিয়ে আমরা ভিন্ন কিছু চিন্তাই করতে পারছি না। অন্যকে নকল করার প্রবণতা আরও প্রবল। কোনো লেখকের বই জনপ্রিয় হলে অন্য একশ জন লেখক সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। নতুন কিছু করার সৎসাহস গড়ে উঠছে না।
আরও দুঃখজনক সত্য হলো, ইসলামি মহল থেকে যারা নতুন কোনো চিন্তা উপস্থাপনের কোশেশ করে, আমরা তাদের নানা তকমা লাগিয়ে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করে দেই। তাকে মডারেট, এজেন্ট, দালাল, ভ্রান্ত বা আরও নানা উপাধিতে ভূষিত করে নিজেদেরকে বিরাট বুজুর্গ হিসেবে জাহির করি।
এটা উচিত নয়। ইসলামে নতুন চিন্তা সবসময় স্বাগত। চিন্তার স্বাধীনতা ইসলামে স্বীকৃত। আপনার চিন্তার সঙ্গে অমত হলেই সেটা ভ্রান্ত নাও হতে পারে। চিন্তার সহাবস্থান জরুরি। চিন্তা দিয়ে চিন্তার সামনাসামনি করতে হবে। গালি দিয়ে তো চিন্তার বিরুদ্ধাচারণ ইসলামসম্মত নয়।
আমরা যদি নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাতে না পারি তাহলে চিন্তাহীন প্রজন্ম তৈরি হবে, যারা নিজেরা কখনো স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে না। যেমন এখনকার আমরা। আমরা নতুন কোনো চিন্তা নিজেরা যেমন তৈরি করতে পারছি না, তেমনি নতুন কোনো চিন্তা কেউ উপস্থাপন করলে আমরা ভীত হয়ে পড়ি, আরে, এটা তো আমাদের ঐতিহ্যের বিরোধী! আমাদের চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক!
এবং এ কারণেই আমাদের আজকের কিশোর-তরুণ মাদরাসাছাত্ররা জানে না যে তারা মাদরাসায় পড়ে আসলে কী হতে চায়। তাকে কেমন হতে হবে―এমন কোনো উদাহরণীয় চিন্তা তার সামনে নেই। কিন্তু তাকে তো এখনই তার চিন্তাকে পরিশীলিত করতে হবে। তার সামনে মুক্ত পৃথিবী, অথচ আপনি তার চিন্তার হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে রেখেছেন। এই শৃংখলাবদ্ধতার দরুণ এই তরুণ হয়তো পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীতে পরিণত হবে, যার চিন্তা করার কোনো ক্ষমতাই কখনো সৃষ্টি হবে না; অথবা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। যেমনটা আমরা প্রায়শই দেখে থাকি।

সুতরাং আজকের যারা ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, কেবল বাজারকাটতি বই প্রকাশ নয়, সমাজের সামনে নতুন চিন্তা উপস্থাপন করুন। সমাজকে আরও গভীরভাবে দেখুন। ঘৃণাভরে নয়, একজন দরদি দাঈ হিসেবে দেখার চেষ্টা করুন। আশা করি আমাদের চারপাশের সমাজই আমাদের নতুন চিন্তা উদ্গত করে আমাদের সাহায্য করবে।