‘গোলাপজল’ এক বহুমাত্রিক জলের নাম। নানা চরিত্রে সে চরিত্রবান। রং-রূপ-গন্ধ-স্বাদ-ব্যবহারে আমাদের জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ জোরালো। গোলাপের বহুরঙা অভিসন্ধির মতো এর এস্তেমালও নানান। গোলাপ পাপড়ির আত্মদানে তৈরি হয় যে পানীয়, কী এমন পুশিদা রহস্য আছে এ স্বচ্ছ জলের ফোঁটায় ফোঁটায়, তার একটা হদিস জানা জরুরি। এক ফাঁকে আসেন তাহলে তলব করি গোলাপজলের এক ছিলিম গোলাপী এলেম।

 

এক.

পহেলা নম্বর গোলাপজলের অস্তিত্ব ইদানীং হুমকির মুখে। এ হলো ছিটানো গোলাপজল। আগে মিলাদ-মহফিল বা ধর্মীয় কোনো রেওয়াজ-অনুষ্ঠান হলে ছিটানো গোলাপজলের উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। মিলাদের ‘ইয়া নবি সালাম আলায়কা’ কোরাসের মাঝে সাহেবে দাওয়াত চিড়িক চিড়িক করে গোলাপজল ছিটিয়ে দিতেন দুলতে থাকা পেয়ারা হাজিরিনদের মুখ-মাথা গায়ে-গতরে। গোলাপজল ছিটানোও সোয়াব। সেটা গায়ে লাগলে সোয়াব বাড়ে বৈ কমে না।

ঈদের নামাজে, শবে বরাত, শবে কদরে, কখনো জুমআর নামাজান্তে শিরনী বিলানোর মচ্ছব থাকলে সেদিনও গোলাপজল ছিটানো হতো। সামান্য খুশবু থাকত, পাঞ্জাবির কাঁধ যেত ভিজে।

ছোটবেলায় ভাবতাম, গোলাপজলের চিড়িক-ছিটা বড় পুণ্যজল। মিলাদ-মহফিলের যেখানে গোলাপজলের ছিটা বেশি বর্ষণের সম্ভাবনা, সেদিকে গিয়ে বসতাম। যদি কখনো ছিটা কম পড়তো, ছিটা বিতরণকারীকে বলতাম, এদিকে এদিকে…।

গোলাপজলের ছিটা জামায় পড়লে কেমন একটা পাক-পবিত্র এহসাস এসে যেত মনের মধ্যে। এখন গোলাপজল ছিটানোর প্রস্তুতি দেখলেই নিজেকে আড়াল করি, দারুণ বিচ্ছিরি লাগে ওগুলোর স্মেল। অবশ্য এখন মিলাদ বা ধর্মীয় জশনে গোলাপজল ছিটানোর দৃশ্য খুব একটা চোখেও পড়ে না।

ছিটানো গোলাপজলের আবশ্যিক উপস্থিতি পাওয়া যায় জানাজায়। জানাজার নামাজে কাতারবন্দী হওয়ার পর মাইয়েতের আত্মীয়-স্বজনরা গম্ভীর মুখে কাতারে কাতারে গোলাপজল ছিটিয়ে দেন। লাশ কবরে রাখার সময়ও গোলাপজল ছিটানোর রেওয়াজ। তবে গোলাপজলের প্লাস্টিকের বোতল ঘরে আনবার রীতি নেই। নীল বা সাদা রংয়ের প্লাস্টিকের বোতলগুলো পড়ে থাকে সদ্য সমাহিত কবরের আলগা মাটির পাশে। বছরের পর বছর ধরে ওখানেই পড়ে থাকে, যতদিন না নতুন আরেকটা কবর খোঁড়া হয়।

আগে, সব মসজিদে নানা উপলক্ষে গোলাপজল জমা হতো। বড় বড় মসজিদে গোলাপজল, আগরবাতি, মোমবাতির স্তূপ জমে যেতো। কিন্তু সময় বদলে গেছে। মসজিদে বিদ্যুত আছে, জেনারেটর বা আইপিস এসেছে; মোমবাতি জ্বালানোর দরকার হয় না। আগরবাতির গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। আতর, পারফিউম আর বডি স্প্রের যুগে গোলাপজল পাততাড়ি গুটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কেবল উরশ আর মাজারে। যা-ও দু-চার জন মান্নত-এহতেরামের নিয়তে মসজিদে দিয়ে যায়, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা সেসব বিক্রি করে মসজিদের ঝাড়ু আর পাপোস কিনেন।

গোলাপি, নীল, সাদা রংয়ের প্লাস্টিক বোতলে সত্যিই গোলাপ নিঃসৃত জল থাকতো কি-না কে জানে! কিন্তু নাম তো হয়েছে গোলাপজল। গোলাপের মতোই পবিত্র।

 

দুই.

বউ একদিন বললেন গোলাপজল আনতে। আমি বললাম, ‘গোলাপজল দিয়ে কী করবা? মিলাদ কই?’

‘আরে পাগল, ওই গোলাপজল না। ত্বকে ব্যবহার করার জন্য আলাদা গোলাপজল।’

‘এমন গোলাপজল আছে নাকি?’

‘আছে, কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে বললেই হবে।’

মনে মনে ভাবলাম, কথা তো ঠিক। গোলাপ সৌন্দর্যের নিশানি, সেটার নিঃসৃত জল তো নারীর রূপচর্চাতেই অধিক ব্যবহার হওয়ার কথা। অথচ গোলাপজলের এই ব্যবহার সম্পর্কে এতদিন আমি ছিলাম বিরাট বেখবর। বইয়ে শুধু পড়েছি, সুন্দরী রানি-শাহজাদীগণ গোলাপের পানিতে সিনান করতেন। আহা! কী বিলাস, কী সৌখিন! কিন্তু সেই গোলাপজল যে বোতলবন্দী হয়ে এ জমানার নারীদের রূপচর্চায় মহান ভূমিকা রাখছে, কে জানতো এ অরূপরতন!

উইকিপিডিয়ায় ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, রূপচর্চায় গোলাপের এস্তেমাল সুপ্রাচীন কাল থেকে। রোমান, পারস্য থেকে শুরু করে হিন্দুস্তানের ডাকসাইটে সুন্দরীতমাগণ গোলাপজলের এস্তেমাল শিখিয়ে গেছেন। মিসরের রানি ক্লিউপেত্রা থেকে শুরু করে সেলিমের আনারকলি, শেবার রানি বিলকিস থেকে উসমানি হেরেমের হুররম সুন্দরী, সবাই ভক্তি করতেন গোলাপজলের। তখন তো ঘরোয়াভাবে তৈরি হতো গোলাপজল। রাজা-বাদশাহদের যা কাজ কারবার, নিজস্ব গোলাপ বাগান থাকতো তাদের, তারাই তৈরি করতো এই সৌখিন ভেষজ প্রসাধনী।

এখানে একটা মজার তথ্য আছে। পারস্যকে (ইরান) মনে করা হয় রূপচর্চায় গোলাপজল ব্যবহারের পীঠস্থান হিসেবে। তারাই ইউরোপ, আরব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গোলাপজল ব্যবহারের তরিকা শিখিয়েছে। তবে অ্যাট ফার্স্ট বাণিজ্যিকভাবে গোলাপজল প্রক্রিয়াজাতকরণ তরিকা আবিষ্কার করেন পারস্যের বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। তার আবিষ্কৃত থিউরি অনুসরণ করে উৎপাদিত পারস্যের মোহময় গোলাপজল বহুমাত্রায় বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোলাপজল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। আরও উমদা তবকার গোলাপজল তৈরির বাসনায় গোলাপের বিভিন্ন প্রজাতি ক্লোন (কলম) করা শুরু হয়। এমনই এক ক্লোন প্রজাতির গোলাপের নাম ‘রোজা দামাস্কানা’। রোজা গ্যালিসিয়া ও রোজা মোশাতা নামের দুই প্রজাতির গোলাপকে ক্লোন করে উৎপাদন করা হয় রোজা দামাস্কানা। ধারণা করা হয় এর উদ্ভব ঘটে দামেস্কে, সেখানেই এর শিশুতোষ পরিপোষণ। তবে বুলগেরিয়া ও তুরস্কে এর উৎপাদন সবচে বেশি হয়। গায়ের রং উজ্জ্বল গোলাপী, অন্যান্য গোলাপের চেয়ে এর আকার বড় এবং গায়ে-গতরে পাপড়ির পরিমাণ অধিক।

মজাদার খাবার ‘নোগাটের’ উপর সরাসরি রোজা দামাস্কানার পাপড়ি বিছিয়ে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে বুলগেরিয়ায়।

তিন.

রান্নার জন্য আলাদা এক গোলাপজল ব্যবহার হয়। এই তবকার গোলাপজলে নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি বা সির্কা মিশিয়ে সেটাকে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। খাওয়ার গোলাপজলের প্রচলনও পারস্য থেকেই আমদানি করা। পারস্যের মুঘলরা যখন ভারতবর্ষে আগমন করেন, তখন অন্য অনেক জিনিসের সঙ্গে গোলাপজলের বাহারি রান্নাও সঙ্গে নিয়ে আসেন।

তবে খাওয়ার এ গোলাপজল স্রেফ হাই লেভেলের রান্না-বান্নার মধ্যে দেয়া হয়। মুঘল সালতানাতের বাতচিতই আলাদা। তারা খানা-খাদ্যতে বড় সৌখিন ছিলেন। বিরিয়ানি, পোলাও, কাবাব, রেজালা, টিক্কা, কোর্মা তারাই রেঁধেছেঁদে আমাদের খাওয়া শিখিয়েছেন। এমন সুস্বাদু রসনাবিলাসের জন্য তাদের ধন্যবাদ না দিলেই নয়।

খানিকটা দুঃখের বিষয়ও রয়েছে। ভোজনরসিকরা পোলাও বা বিরিয়ানিতে গোলাপজলের এস্তেমাল বরাবর নাপছন্দ করে থাকেন। তাদের ধারণা, ওজনদার খাবারে গোলাপজল দিলে খাওয়ার রুচিতে বিঘ্ন ঘটে। বিঘ্নতার কারণে পোলাও-বিরিয়ানি পরিমাণে কম খাওয়া যায়। অনেকে আড়ালে আবডালে এমনও অভিযোগ করেন, মূলত মেহমানদিগের খাওয়ার লিমিট সীমিত রাখতে ওই গোলাপজলটা মিক্সআপ করা হয়।

কিন্তু এ কথা পুরোপুরি সত্য নয়। পোলাও বা বিরিয়ানিতে গোলাপজল দেয়া হয় মূলত ফ্লেভারের জন্য, স্বাদের রুচিতার জন্য। তবে গোলাপজল ব্যবহারের যে মাত্রা তার থেকে সামান্য উনিশ-বিশ হলে স্বাদের হেরফের হতে পারে। যেহেতু গোলাপজল হাই লেভেলের রসনা, সচরাচর এর ব্যবহার দুষ্প্রাপ্য, এ কারণে এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে আকছার বাবুর্চিই অজ্ঞ। বাবুর্চির অজ্ঞতার কারণে আপনার ভুরিভোজে ব্যঘাত ঘটলে গোলাপজলের কী কসুর! সুতরাং গোলাপজলের ওপর থেকে অহেতুক শক-সন্দেহ তুলে নিতে ভোজনরসিকদের প্রতি জোর নিবেদন থাকবে।

রান্নার গোলাপজল থাকে কাচের বোতলে। যেনতেন দোকানে এ গোলাপজল মওজুদ থাকে না, বাজারের পুরোনো বনেদী দোকানগুলোতে কেবল এর দিদার পাওয়া যায়। অবশ্য শহরের সুপার স্টোরগুলোতে এখন দেদার মিলে, দিশি-বিদিশি দুই কিসিমেরই। কনজিউমার কোম্পানিগুলোর কথা আর কী বলব, খাওয়ার এমন কোনো জিনিস নেই যেটা তারা উৎপাদন করছে না। খিচুরি তো অলরেডি প্যাকেটজাত হয়ে মুদি দোকানে বিক্রি হচ্ছে, কয়েকদিন পর ভাত তরকারিও প্যাকেট কিনে খেতে হবে। কচুর লতি আর ডালই বা বাকি থাকবে কেন, বেগুন ভর্তা আর সবজির লাবড়ার ব্যাপারেও আশাবাদী হোন। আর তো দিন কয়েকের ব্যাপার মাত্র! নাকি এরই মধ্যে বাজারে চলে এসেছে এসব? ইয়া পরওয়ারদেগার!

আধুনিককালে খাওয়ার গোলাপজলের বহুবিধ এস্তেমাল রয়েছে। জুস, মিল্কশেক, আইসক্রিম, ডেজার্ট, পুডিংসহ নানা কনফেকশনারি খাবারে গোলাপজল এস্তেমাল করা হয়। অ্যালকোহলমুক্ত অনেক ল্যামোনেড পানীয় এবং বেভারেজেও ব্যবহৃত হচ্ছে গোলাপজল। এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপেও গোলাপজলের পদাতিক যাত্রা শুরু হয়েছে।

লেখার শেষাশেষি একটুখানি ভিন্ন সোয়াদ নিয়ে যান।

ইংল্যান্ডের ফুটবল কাপ ‘উয়েফা প্রিমিয়ার লিগ’-এর রীতি হলো, টুর্নামেন্টে যে দল জিতবে তারা শ্যাম্পেনের বোতলের ছিপি খুলে উৎসব উদযাপন করবে। কিন্তু এই জশনে জুলুসে একটা সমস্যা দেখা দিল। অনেক ক্লাবে মুসলিম খেলোয়াড় থাকেন যারা অ্যালকোহল পান করেন না; তাদের সামনে অ্যালকোহল নিয়ে সেলিব্রেশন করাটা শরমিন্দিগির ব্যাপার। তাই লিগ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছিল, প্রিমিয়ার লিগে যে দল জিতবে, সে দলে যদি মুসলিম খেলোয়াড় থাকে তবে শ্যাম্পেন নয়, শ্যাম্পেনের বদলে গোলাপজল ব্যবহৃত কোনো পানীয়ের বোতল খুলে সেলিব্রেট করতে পারবে।

এই রীতি এখন আর আছে কি-না, জানি না।