বাংলা সাহিত্যের একটা বড় ছন্দপতন—সাহিত্য গ্রাম ছেড়ে নগরমুখী হয়েছে এবং তৃণমূল চারণ কবিদের স্থান দখল করেছেন শিক্ষিতশ্রেণি। এখন কবি-লেখক বলতেই শিক্ষিত হওয়া বাঞ্চনীয়। এটা সাহিত্যকে বিকেন্দ্রিত করে ফেলেছে।

কিন্তু হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিদের সঙ্গে শিক্ষার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। যার হৃদয়জ ভাব-ব্যঞ্জনা তীক্ষ্ণ ও গভীর হতো, সে-ই কবি। যার পুঁথি ও গান বাঁধবার সৌকর্য থাকতো, তিনি হতেন অত্রাঞ্চলের প্রথিতযশা। এর জন্য নগর বা রাজধানীর প্রয়োজন হতো না। প্রতিটি গ্রামীণ জনপদে বিরাজ করতেন কবিগণ। সন্ধ্যা হলেই পাড়া-মহল্লায় জ্বলে উঠতো হ্যাজাক বাতি। হল্লা করে স্বরচিত পুঁথিপাঠ হতো। এক গ্রামের কবিগণ পালা লড়তে যেতেন আরেক গ্রামের কবিগণের সঙ্গে। এদের তেমন কোনো আক্ষরিক বিদ্যাজ্ঞান থাকতো না। মুখে মুখে। শত শত—অনেকে হাজার হাজার কবিতা-পুঁথি-গীতি মুখস্থ বলতে পারতেন।

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সাহিত্য নগরের দিকে যাত্রা করে। এর প্রধান কারণ আমার মনে হয়েছে—কাগজ ও ছাপার সহজলভ্যতা। এ দুটো জিনিস যেহেতু অক্ষর ও শিক্ষাকে ধারণ করে, ফলে সাহিত্য গ্রামের সাধারণ মানুষের মুখ থেকে শিক্ষিতশ্রেণির কাগজে উঠে এসেছে। অধুনা এক শ বছরের মধ্যে গ্রাম থেকে সাহিত্য পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে।

আমাদের ছোটবেলায় পুঁথিপাঠ ও মৌখিক সাহিত্যের খানিকটা রেওয়াজ ছিল, কিন্তু বর্তমানে এই ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরই সঙ্গে বিলোপ হয়েছে হাজার হাজার পুঁথি, লোকগান, রূপকথা, মিথ এবং অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। এসবের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন, মাসুদ রানার থ্রিলার আর ডিসি-মার্ভেলের আজগুবি কমিক-চরিত্র। এসবই নগরকেন্দ্রিক সাহিত্যের বড় বড় মারণাস্ত্র।

নগরমুখী সাহিত্য-প্রবণতা বাংলা সাহিত্যকে লৌকিক আভিজাত্য দিয়ে হত্যা করেছে সহস্র বছরের ঐশ্বর্যময় মানবিক সাহিত্যকে।