১৮ এপ্রিল ১৯৯৪। কান্দাহার প্রদেশ, আফগানিস্তান।
সোভিয়েত সৈন্যরা ১৯৮৯ সালে চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তান তখন তার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। একদিন যারা মাতৃভূমির মাটিকে হানাদার শত্রুর কবল থেকে রক্ষার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, আজ তারাই বিভিন্ন গোত্র, জাতিসত্তা ও আঞ্চলিক বিভেদে জড়িয়ে পরস্পরে রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে। কাবুল, কান্দাহার, মাজার-ই-শরিফ, খোস্ত, বাগরামসহ প্রতিটি প্রদেশ গৃহযুদ্ধের দাবানলে জ্বলছে দাউ দাউ করে। এক জাতিসত্তার যোদ্ধারা হত্যা করছে আরেক জাতিসত্তার যোদ্ধাদের, লুট করছে তাদের বাড়িঘর। এমনকি বিরুদ্ধপক্ষের নারীদের নিপীড়নের ঘটনাও ঘটছে যত্র তত্র। জননিরাপত্তার বালাই নেই কোথাও, সর্বত্র অরাজকতা জাঁকিয়ে বসেছে।

কান্দাহার থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে সিনগেছার এলাকার ঘিশানো গ্রাম। এ গ্রামের হাজি ইবরাহিম মসজিদ সংলগ্ন মাদরাসায় অল্প কিছু ছাত্রদের কুরআন পড়াচ্ছিলেন মৌলভি উমর নামের একজন সাধারণ শিক্ষক। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন তিনিও। বহু সম্মুখ সমরে লড়াই করেছেন আর দশজন মুক্তিকামী আফগানীর মতো। যুদ্ধের নজরানা স্বরূপ নিজের একটি চোখ হারিয়েছেন তিনি। রুশবাহিনী চলে যাওয়ার পর দৃষ্টিসম্পন্ন একটি চোখে স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন এক আফগানিস্তানের। আবার পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর উপত্যকায় রূপ নেবে তার মাতৃভূমি। গর্ব করে পৃথিবীর মানুষের সামনে বলতে পারবেন―ইঁ-হাস্ত ওয়াতনম।

কিন্তু তার সে স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে ওয়ারলর্ড হিসেবে পরিচয় পাওয়া গোত্রীয় নেতাদের লোভ আর লালসার মরণখেলায়। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির নেশায় এখন তারা হত্যা করছে নিজেদেরই সহযোদ্ধাদের। তাই সবকিছু থেকে নিরাশ হয়ে অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো মৌলভি উমর নিজেকে থিতু করেছেন দূর গ্রামীণ জনপদে। এখানে ছাত্রদের পড়িয়ে যে মাইনে পাওয়া যায়, তা দিয়ে কোনোরকম ঘর-সংসার চলে যায় তার। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজনও নেই। তার বাবা মৌলভি গোলাম নবি তাকে এমন শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। তিনি নিজেও স্বল্প পারিশ্রমিকে কুরআন শেখাতেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের। এভাবেই নিঃস্ব গোলাম নবি একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

তবে উমরের বাবা গোলাম নবি ছেলের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ রেখে না গেলেও ছেলেকে দিয়ে গেছেন জীবনযুদ্ধের অমূল্য এক শিক্ষা―ন্যায়বিচার, অন্যায়ের সামনে কখনো মাথানত করবে না।

মৌলভি উমর সেদিন মাদরাসায় ছেলেমেয়েদের কুরাআন পড়াচ্ছিলেন যখন, আচমকা গ্রামের ভেতর থেকে শুনতে পেলেন কোনো নারীর বুকফাটা চিৎকার। উমর নারীর চিৎকার শুনে ছুটে গেলেন, সঙ্গে তার ছাত্ররা। গিয়ে দেখেন, এক মা আর্তনাদ করে বলছে, ‘আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে, অপহরণ করে নিয়ে গেছে ওরা। ওরা আমার মেয়েকে বাঁচতে দেবে না…।’

অক্ষম্য ক্রোধে জ্বলে উঠল উমরের সারা শরীর। খবর নিয়ে জানতে পারলেন, এ গ্রামের আরেকজন মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে কান্দাহারের এক যুদ্ধবাজ ওয়ারলর্ড নেতা। নিজের ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাদের। সেখানে অপহরণ করে আনা আরও মেয়েদের সঙ্গে তাদের ওপরও চলছে অমানবিক নিপীড়ন। ক্যাম্পের সকল যোদ্ধা মিলে গণধর্ষণ করেছে প্রতিটি মেয়েকে।

এভাবে আর কত সহ্য করা যায়? দেশরক্ষার নামে, ধর্মের নামে এভাবে আর কত অধর্ম হতে দেখবেন তিনি? যে ইসলামি সালতানাতের স্বপ্ন দেখতেন তিনি, সে দেশ আজ হয়ে উঠেছে পাপের অভয়ারণ্য। এজন্যই কি স্বাধীন করেছিলেন এই আফগান উপত্যকা? তিনি তার বাবার দেয়া শিক্ষাটা আরেকবার মনে মনে আওড়ালেন―ন্যায়বিচার, অন্যায়ের সামনে কখনো মাথানত করবে না।

১৯৯৪ সালের ১৮ এপ্রিল। সেদিন ছিল সোমবার।
মৌলভি উমর তার কয়েকজন পুরোনো ছাত্রকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনলেন তার মাদরাসায় (আরবিতে ছাত্র অর্থ তালিব, বহুবচন তালিবান)। সঙ্গে বলে দিলেন, খালিহাতে এসো না, নিজেদের অস্ত্রগুলো সঙ্গে এনো। চলতি-পুরাতন মিলিয়ে ৩০ জন ছাত্র হাজির হলো সন্ধ্যাবেলা। ১৬টি চলনসই আগ্নেয়াস্ত্র যোগাড় করতে পেরেছে তারা। উমর সন্তুষ্ট হলেন, অপহৃত দুজন মেয়েকে উদ্ধার করতে এবং ওই ওয়ারলর্ড নরপশুটাকে উচিত শিক্ষা দিতে এই সম্বল যথেষ্ট।

উমর রাতের আঁধারে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন যুদ্ধবাজ নেতার ডেরায়। ফূর্তিতে মশগুল চরিত্রহীন যোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করার সুযোগ পেল না। উমরের কৌশলী আক্রমণে অধিকাংশ যোদ্ধা নিহত হলো, কয়েকজন পালিয়ে বাঁচল, ছাত্রদের হাতে গ্রেফতার হলো বাকি কয়েকজন। ক্যাম্পের জিন্দান থেকে মুক্ত করা হলো নিপীড়িত মেয়েদের।

ওয়ারলর্ড―যার আদেশে অপহরণ করা হয়েছিল নিষ্পাপ মেয়েগুলোকে, তাকেও গ্রেফতার করা হলো আহত অবস্থায়। গ্রেফতার করে তাকে রাতের আঁধারেই কান্দাহার শহরের একটি সড়ক চত্বরে নিয়ে যাওয়া হলো। এ চত্বরে একটি বিরাট আকারের বিধ্বস্ত ট্যাংক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মৌলভি উমরের ছাত্ররা ওই নেতাসহ গ্রেফতার করা প্রত্যেক ধর্ষককে ট্যাংকের ব্যারেলে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে দিল।

পরদিন দিনের বেলায় কান্দাহারের হাজার হাজার মানুষ দেখল, অন্যায় ও অবিচারের শাস্তিতে ফাঁসিতে ঝুলছে এক ওয়ারলর্ড। ভবিষ্যতে কেউ এমন করলে তারও এভাবে শাস্তি হবে। ব্যাস―Justice begin here…

উমরের সেদিনকার সেই ন্যায়বিচার পুরো কান্দাহারে এক নতুন বারতা দিয়ে গেল। নতুন এক আফগানিস্তানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল সেই ন্যায়বিচারের ফাঁসির মঞ্চে। মাত্র দুই বছরে যে বারতা ছড়িয়ে পড়েছিল খোস্ত, বাগলান, মাজার-ই-শরিফ, গজনি, হেলমান্দ, হেরাত, কুন্দুজ, বলখ, পাঞ্জশিরসহ পুরো আফগানিস্তানে।

সেই বারতার নাম তালেবান। ২৭ বছর পর যারা নতুন মৌলভি উমরের ন্যায়বিচারের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নতুন এক আফগানিস্তান গড়ার সংগ্রামে সরকার গঠন করেছে।

——
ছবি: Nathan Derrick,  gettyimages.com