ধরা যাক, আমি সময়-অসময়ে ফেসবুকের নিউজফিড ঘাঁটছি। ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটি লেখায় পেলাম বন্ধুর বাবার মৃত্যুসংবাদ। তার পরে দেখলাম আরেক বন্ধু তাঁর বউয়ের হাতে বানানো কুমড়ার মুরব্বা চিবুচ্ছে—সেই ছবি ও খবর। পরের লেখায় পড়লাম ‘নাস্তিকের জানাজা কেন পড়া যাবে না’—এমন ধর্মসিদ্ধ বিষয় নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক।

তো, এসব দেখে আমি যেটা করলাম, বন্ধুর বাবার মৃত্যুসংবাদে মন্তব্য করলাম—‘কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে, তাঁর মতো একজন ভালোমানুষ চলে যাবেন মেনে নিতে কষ্ট হয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন!’ সঙ্গে দুঃখ ভারাক্রান্ত একটি স্যাড রিয়্যাক্ট দিয়ে দিলাম। এসব ব্যাপারে কিপ্টেমি চলে না।

যে বন্ধু বউয়ের বানানো চালকুমড়ার মুরব্বা চিবানোর ছবি দিয়েছে, তাঁর ছবির নিচে দাঁত কেলানো হাসির রিয়্যাক্ট দিয়ে মন্তব্য করলাম—‘ওরে শালা! বউ নিয়া দিনের বেলা একা একা মুরব্বা চাবাইতেছিস, আমরা কি মইরা গেছি নাকি!’ মুরব্বার জেল্লাদার চেহারা দেখে মনটা আঁকুপাকু করছে।

যাকগে, পরবর্তী লেখা যেটা চোখে পড়লো, একটা পাবলিক গ্রুপে ‘নাস্তিকের জানাজা কেন পড়া যাবে না’—এ নিয়ে ইসলামিস্ট এবং ননইসলামিস্ট লোকজন বিপুল বেগে বিতর্ক শুরু করেছে। তাদের তর্কের গতি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, দুম করে একটা মারমুখী মন্তব্য করে বিতর্ক যথাসম্ভব উস্কে দেয়ার চেষ্টা করলাম। ধর্ম জিনিস এতো সোজা না!

ফেসবুক নামের মহাঅরণ্যে এই যে আমাদের চিন্তা ও মানসিকতার ত্বরিৎ পরিবর্তন, মুহূর্তে দুঃখে জর্জর হয়ে কান্নার পরিবেশ সৃষ্টি করছি, দু সেকেন্ড পরই হাহা করে হাসছি, আবার মুহূর্তেই আমাদের মধ্যে ফুঁসে উঠছে চরম অসহিষ্ণু এক দানবব্যক্তি, একটু পরই কোনো ললনার দিকে ছুড়ে মারছি চটুল মন্তব্য; মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে আমার চরিত্র থেকে চার ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। এটা কি মানুষ হিসেবে আমাদের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ?

আমরা নিজেরাই এখন নিজেদের চিনতে পারি না—কোনটা সত্যিকারের আমি। যে আমি বন্ধুর বাবার মৃত্যুসংবাদে দুঃখে বিমূঢ়—সে আমি? নাকি যে মুরব্বা চিবোনোর খায়েশে লালায়িত, সে? নাকি ভরা বিতর্কসভায় গালি দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা লোকটি আমি? একজন স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে মুহূর্তে মুহূর্তে তো এতো ট্রান্সফর্মেশন হওয়া সম্ভব না। এর দ্বারা পরিস্কার হয়ে যায়, হয়তো ব্যক্তি হিসেবে আমি নিতান্ত ব্যক্তিত্বহীন অথবা আমার প্রকাশ করা সকল দুঃখ, আনন্দ, রাগ, চটুলতা সকলই ফেইক, সবই লোকদেখানো।


অস্বীকার করার জো নেই, ফেসবুক বা অন্যান্য সোস্যাল নেটওয়ার্ক প্লাটফর্মে নিজেকে জাহির করার তাগিদ ধীরে ধীরে আমাদের যেমন ব্যক্তিত্বহীন করে ফেলছে, তেমনি আমাদের আবেগ-অনুভূতিকেও করে তুলছে কেবলই লোকদেখানো। ছেলেরা এখন চুল কাটছে ফেসবুকে ছবি আপলোড করার জন্য, মেয়েরা পার্লারে গিয়ে সেজেগুজে আসে সেলফি তুলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে কিসের বিয়ের আয়োজন বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, সবাই ব্যস্ত সেলফি তোলা আর ফোনে ফেসবুকে। চারপাশের পৃথিবী থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে আমরা প্রকাশিত হচ্ছি অন্য আরেক পৃথিবীতে। যে পৃথিবীতে সকলই ভার্চুয়াল, সব কিছু অন্তর্জালের ফেইক কারনামা।

সেদিন ফেসবুকে একটি ছবিতে দেখলাম, কয়েকজন জুব্বাপরা মওলানা সাহেব কোনো এক কবরস্তানে গিয়েছেন কবর জিয়ারত করতে। হয়তো কোনো ধনীব্যক্তির বাবা-মায়ের কবর হবে। ধনীব্যক্তির বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে গিয়েছেন কবর জিয়ারত করতে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সব ক’জন মওলানা হাত তুলে কবরবাসীদের জন্য দোয়া করছেন। এক মওলানা স্মার্টফোন দিয়ে সেলফি তুলছেন। মওলানাগণ কবরবাসীদের জন্য হাত তুলে দোয়া করতে করতেই ক্যামেরার দিকে হাস্যবদনে তাকিয়ে আছেন। কী নিদারুণ সোস্যাল হচ্ছি আমরা!

বুঝতে পারছেন আমাদের মানসিকতার লেভেলটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
আস্তে আস্তে আমাদের চারপাশটাই মেকি হয়ে যাচ্ছে, খুব বেশি করে হয়ে যাচ্ছে। অন্যের সামনে নিজেকে প্রদর্শনের এমন সস্তা মানসিকতা পরিহার অতিআবশ্যকীয়।


মাসিক নবধ্বনির সৌজন্যে