‘নবধ্বনি পড়ে কেউ লেখক-সাহিত্যিক হয়ো না, নবধ্বনি পড়ে কেউ দিগি¦জয়ী আলেম হয়ো না, নবধ্বনি পড়ে কেউ সভ্য-নম্র-ভদ্র হয়ো না; নবধ্বনি কোনো জাদুর যষ্ঠি নয়, নবধ্বনি পড়ে পারলে একজন মানুষ হয়ো!’
বছর কয়েক আগে নবধ্বনির কোনো এক সংখ্যায় এ কথাগুলো পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছিল। এ কথাগুলোর মাঝে ছোট্ট নবধ্বনির অনেকটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। নবধ্বনি ঋজু, তবে অহমবোধে গর্বিত হওয়ার মতো রসদ নেই তার। তবে ভালোবাসা বিলিয়ে ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষমতা অসীম।
মাঝে মাঝে অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে আচমকাই জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের ছোট্ট একটা পত্রিকা ছিল নবধ্বনি নামে, সেটার কী অবস্থা? অনেক ভালো লাগতো পত্রিকাটা…। এই, নবধ্বনির প্রাপ্তি দিনশেষে এইটুকুই যথেষ্ট। এই ভালোবাসাটুকুর জন্যই নবধ্বনি ক্লান্তির জঞ্জাল সাফ করে ফের ভেসে ওঠে, ডুবে আবার মস্তক উঁচিয়ে জানান দেয়Ñ জিন্দা হ্যায়!
কয়েক মাস আগে যখন হঠাৎই মনে হলো, নবধ্বনি তার প্রকাশের দশ বছর পার করেছে; সত্যি বলছি, নিজের কাছেই কেমন বেখাপ্পা লেগেছিল। দশ বছর কেমন করে হয়! এমন দশ বছরী, বিশ বছরী স্মৃতিতর্পণ তো বড় বড় পত্রিকা-ম্যাগাজিনের বেলায় হয়। নবধ্বনির মতো ছোট্ট ম্যাগাজিন দশ বছর পার করলো কীভাবে? নাকি হিসাবে ভুল হল। আঙুল গুনে গুনে বছর গণনা করে দেখি। সত্যিই দশ বছর!
মনে পড়ে, প্রথম সংখ্যাটা ছাপা হওয়ার আগে আমি আর আনছারুল হক ইমরান ভাই গিয়েছিলাম প্রচ্ছদশিল্পী নাজমুল হায়দারের কাছে প্রচ্ছদের সফট কপি আনার জন্য। ২০০৭ সালের কথা। নাজমুল ভাইয়ের তখন নয়া পল্টনে অফিস। গিয়ে দেখি তিনি অফিসের নিচে একটা আঙিনামতো জায়গায় র্যাকেট খেলছেন। আমাদের দেখে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলেন। খেলা শেষ হলে তাঁর অফিসে গেলাম। তিনি সম্ভবত বিএনপি ঘরানার লোক ছিলেন, অফিসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছবি-টবি লাগানো ছিল। তিনি কম্পিউটার থেকে সিডি ডিস্কে কভারটা কপি করে আমাদের হাতে দিলেন। আমার কোনো ধরণাই ছিল না এই সিলভার ডিস্ক থেকে কীভাবে একটা জলজ্যান্ত পত্রিকার কভার বেরোবে! এমনই আনকোরা বোকা ছিলাম আমরা।
পত্রিকার ভেতরের পাতাগুলো ডিজাইন করতেন নীলক্ষেত ইউনিভার্সিটি মার্কেটের ডিজাইনার মনির ভাই। তাঁর কাছে আসা-যাওয়ার দুয়েকদিন পর জানতে পারলাম, তিনি আমাদের ধামরাইয়ের লোক। সে হিসেবে বেশ চিন-পেহচান হয়ে গেলো। অনেক দিন পর্যন্ত মনির ভাই নবধ্বনি ডিজাইন করে দিয়েছেন। একটা সময় নবধ্বনির ভালো-মন্দে তিনিও একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিলেন। এখনও মাঝে মধ্যে যাত্রাপথে গাড়িতে কিংবা নীলক্ষেত গেলে মনির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। সহাস্যে জিজ্ঞেস করেন, আমার নবধ্বনির কী খবর?
মনির ভাই বড় আপন ছিলেন আমাদের। এখনও কোনো প্রয়োজনে যদি ইউনিভার্সিটি মার্কেটের সামনে দিয়ে যাই, স্মৃতি এসে কোলাহল করে ওঠে, কতো দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে তামীম ভাই, ইমরান ভাই, আমি এসে মনির ভাইয়ের ছোট্ট দোকানটাতে গাদাগাদি করে বসে থেকেছি। নবধ্বনি জন্মের নাড়ীর আঁচড় লেগে আছে মনির ভাইয়ের ‘দেশ-বাংলা গ্রাফিক্স হাউজ’-এ। এ দাগ মুছবে না কোনোদিন।
আসলে দশ বছর তো তেমন কিছুই নয় এক অর্থে। এভাবে সামান্য বিষয় নিয়ে স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মতো ঘটনাও বড় বাহুল্য শোনায়। কিন্তু ছোট বলে নবধ্বনির কাছে এসবের দারুণ দাম।
দশম বর্ষে পদার্পণ করার যাত্রাপথে নবধ্বনির জন্য এক বুক ভালোবাসা।