যাক, এতক্ষণ কেবল হতাশ্বাসের কথা বললাম। এবার কিছু আশাবাদের কথা বলা যাক।

পরিবর্তন হচ্ছে, ধীরে হলেও হচ্ছে। লেখক-অনুবাদকদের মধ্যে যেমন হচ্ছে তেমনি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তন আসছে। একসময় মনে করা হতো, ধর্মীয় বই লেখা সোয়াবের কাজ তাই বই লিখে সম্মানী নেয়াটা গোনাহ। অনেক আলেম-লেখক নিতেনও না। কিন্তু এখন ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি একটা প্রফেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমি মনে করি, এটাই হওয়া উচিত। যে লেখক নিজের মেধা, সময়, শ্রম ব্যয় করে একটি বই লিখেলেন, হোক সেটা ধর্মীয়, তাঁকে অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য সম্মানী বুঝিয়ে দেয়াটা ফরজ।

আমি আমার অনেক লেখকবন্ধুর ব্যাপারে জানি। তাঁদের যদি প্রশ্ন করি, আপনি মৌলিক কিছু লিখছেন না কেন? এভাবে অনুবাদ করে করে তো ইসলামি সাহিত্য বলতে কিছু দাঁড়াবে না। তখন তাঁর সোজাসাপ্টা উত্তর, এমন প্রকাশক কই? আমি ছয় মাস রক্ত-ঘাম ব্যয় করে একটি মৌলিক বই লিখলাম, তারপর সেটা কোনো প্রকাশককে দেয়ার পর প্রকাশক আমাকে ফর্মাপ্রতি বড়জোর আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দেবে (১ ফর্মা=১৬ পৃষ্ঠা)। অথচ এ ছয় মাসে আমি যদি অনুবাদ করি তবে তাহলে নিদেনপক্ষে তিনটি বই অনুবাদ করতে পারবো। যার সম্মানীও ওই মৌলিক বইয়ের সমান হারেই পাবো। তাহলে কেন শুধু শুধু আমি মৌলিক বই লিখতে যাবো। দিনশেষে আমারও পেটের চিন্তা করতে হয়।

আবার মজার বিষয় হলো, কোনো প্রকাশককে যদি প্রশ্ন করি, আপনারা অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক বই প্রকাশ করেন না কেন? তখনা তাদের জবাবও খুব সাফÑমৌলিক বই লেখার মতো লেখক কই? আমাদের লেখকদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাঁকে দুই-চার হাজার টাকা বেশি দিয়ে একটা মৌলিক বই লেখাবো।

সুতরাং এখানে উভয় পক্ষ থেকেই গাফলতির প্রশ্ন তোলা যায়। তবে সবচে বড় যে বিষয়টি মৌলিক সাহিত্য বা মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ রচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেটা হলো আর্থিক বিষয়। বাংলাদেশে ইসলাম বিষয়ে মৌলিক সাহিত্য বা গবেষণাগ্রন্থ লেখার লেখকের যেমন অভাব নেই তেমনি এমন মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করার মতো প্রকাশকেরও অভাব নেই। এর প্রমাণও আছে। বর্তমানে কিছু কিছু প্রকাশনী যোগ্য সম্মানীর মাধ্যমে ভালো লেখকদের দিয়ে অনেক মৌলিকগ্রন্থ প্রকাশ করছেন।

কিন্তু এ ধারা এখনও ততটা শক্তিশালী নয়। অনেক ইসলামি প্রকাশনী লেখকসম্মানী বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক বেখেয়াল। এই সম্মানী বিষয়টি যখন পেশাদারিত্বের আবহে উভয় পক্ষকে সমঝদার করবে, তখনই কেবল সৃষ্টিশীল মৌলিক কাজ হতে পারে। অন্যথায় সারাজীবন আমাদের অনুবাদ আর কপি-পেস্টের যাতনা সহ্য করে যেতে হবে। মৌলিক সাহিত্য যেমন সৃষ্টি হবে না, তেমনি সাহসী প্রকাশকও তৈরি হবে না।

বিদেশি উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে একজন লেখক একটি বই প্রকাশ করে আরামে বছরখানেক শুয়ে বসে কাটাতে পারেন। কারণ একটি বই লিখে সম্মানী বাবদ তিনি যে অর্থ পান তা দিয়ে তাঁর পরবর্তী এক বছর আরামছে চলে যায়। এই একটা বছর তিনি নতুন আরও দুটি বই লেখার জন্য যথেষ্ট গবেষণা ও অনুসন্ধানের সময় পান। এ সময়টা কাজে লাগিয়ে তিনি আবার নতুন দুটি বই লিখে ফেলেন।

আর আমাদের প্রকাশনীগুলো যে সামান্য সম্মানী লেখকদের জন্য বরাদ্দ করেন, তা দিয়ে কোনোমতে দু’মাসের বাড়িভাড়া দেয়া যায়। বাজার-সদাই আর সংসার চালানোর জন্য তখন লেখক মহোদয়কে নানা ধান্ধায় ছুটতে হয়। ধান্ধায় দৌড়াতে দৌড়াতে বই লেখার সময় কই! কিন্তু সত্যিকারার্থে যদি আমাদের প্রকাশক আর লেখকদের মাঝে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠতো তবে লেখকরা যেমন ভালো বই লেখার অনুপ্রেরণা পেতেন তেমনি প্রকাশকরাও মৌলিক বই ছাপিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পেতেন। দুই নম্বরি করে বিদেশি বই অনুবাদ কিংবা আরেক প্রকাশনীর বই মারিং-কাটিং করে ছাপানোর প্রয়োজন হতো না। লাভবান হতেন দুই শ্রেণির মানুষই।