ওয়াজ-মাহফিলকে যদি ধর্মীয়-ব্যবসা মনে করেন, আর ওয়ায়েজ-বক্তাকে যদি ব্যবসায়ী/স্টেজ পারফর্মার হিসেবে সাব্যস্ত করেন, তাহলে একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়িক পণ্য (ওয়াজ-মাহফিল) বাজারজাত করতে চটকদার নানা পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, এতে ‘জাত গেল জাত গেল’ বলার মতো তেমন কিছু দেখি না।

নিজের প্রোডাক্টকে (ওয়াজ-মাহফিল) আরও বেশি বাজারবান্ধব করতে কেউ সুরের ঢেউ তুলবেন, কেউ বাংলার মাঝে মাঝে ইংরেজি-আরবিতে বয়েত পড়বেন, কেউ আজান দিবেন, কেউ ট্রাম্প-ম্যানইউ নিয়ে চাপাবাজি করবেন, কেউ ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম ক্রিম মেখে স্টেজে উঠবেন, কেউ নাচবেন কুঁদবেন, গান গাইবেন, ভাঁড়ামো করবেন—একজন সৎ পণ্যবিক্রেতা ব্যবসায়ী হিসেবে এটা করার অধিকার তার রয়েছে।

এখন কথা হলো, ওয়াজ-মাহফিলকে আপনি ব্যবসা মনে করেন কি-না। আমার মতে, ওয়াজ-মাহফিলকে ব্যবসা হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত। হোক সেটা ধর্মীয়-ব্যবসা। ধর্মীয় নানা মাধ্যম নিয়ে কি এই দুনিয়ায় ব্যবসা হচ্ছে না? আমরা ধর্মীয় পুস্তকাদি লিখে প্রকাশ করে নগদ নারায়ণ কামাচ্ছি। বই বিক্রির জন্য চটকদার নানা অফার, মেলা, বিজ্ঞাপন, প্রচারণা করছি না? আল্লামাগণ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে পয়সা গুনছেন, ছোট আল্লামারা মাদরাসায় পড়িয়ে পয়সা গুনতে বেকারার হচ্ছেন। এসব আল্লামারা তাদের বেতনের জন্য মাদরাসার উন্নয়নমুখী নানা কাজে কসরত করেন না? মাদরাসার উন্নতি মানেই তো তার উন্নতি। সবাই তো আমরা ইসলামের ধ্বজা ধরেই অর্থোপার্জন করছি, তাই না?

তাহলে বক্তাগণ তাদের ব্যবসার পসরা জমাতে নানা কসরত করলে আমাদের এত রুচিবোধে লাগে কেন? ধর্মে কোথাও লেখা নেই যে, ধর্মীয় মাদরাসায় পাঠদান শেষে টাকা নিতে পারবে কিন্তু ধর্মীয় বক্তব্য দেয়ার পর টাকা গ্রহণ করা হারাম।

হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন যে ধর্মীয় বক্তব্যের নামে তারা যে কীর্তি-কাণ্ড করে থাকেন সেগুলো অরুচিকর। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, এই দেশে ধর্মীয় সমাজের কোন মাধ্যমে আপনি অরুচির দেখা পান না? মসজিদের ইমামতি থেকে শুরু করে বিরাট বিরাট মাদরাসা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে শুরু করে ধর্ম মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দেখুন, সর্বত্র ধর্মের নামে অরুচির চর্চা চলছে।

সুতরাং প্রতি ওয়াজে ৫০ হাজার টাকা কামানো বক্তার আয়-রোজগার দেখে তার প্রতি আমাদের বিদ্বেষকে ধর্মীয় সুরুচির দোহাই দিয়ে প্রণোদনা দেয়ার তেমন কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।

বরং একটা কাজ করা যেতে পারে।

ধর্মীয় ওয়ায়েজ-বক্তাদের আয়-উপার্জনকে করের (Tax) আওতায় আনা যেতে পারে। প্রতি মাহফিল বাবদ তারা কী পরিমাণ আয় করছেন, এই হিসাবটা তাদের স্বচ্ছ রাখতে হবে। মাহফিল এন্তেজামিয়া কমিটি তাদের যে পরিমাণ অর্থ তাকে প্রদান করছে, সেটার রশিদ তাকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সময়মতো আয়কর অফিসে গিয়ে রশিদ দেখিয়ে আয়কর (Income Tax) পরিশোধ করতে হবে।

একজন স্টেজ পারফর্মার হিসেবে অন্য মাধ্যমের শিল্পীরা যে পারিশ্রমিক পান এবং তার বিপরীতে তারা নির্ধারিত যে পরিমাণ আয়কর প্রদান করেন, একজন ওয়ায়েজ-বক্তাকেও সে আওতায় আনা যেতে পারে। অর্থের লেনদেন যেহেতু এখানে স্টেজে পারফর্মের ওপর নির্ভর করে, মানুষের হেদায়েত বা শ্রোতাদের ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না, এ জন্য আমার মনে হয় এই মাধ্যমকে স্টেজ পারফর্ম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তাছাড়া চেহারার সৌন্দর্য ও সুরের মাধুর্যও যেহেতু এই মাধ্যমে আয়ের বড় ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করে, যেমন সিনেমার অভিনেতা ও সংগীতশিল্পীদের জন্য প্রযোজ্য, সেহেতু ওয়াজ-মাহফিলের বক্তাদের স্টেজ পারফর্মার হিসেবে গণ্য করাই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।

এই হিসেবে আমরা মনে করি, স্টেজ পারফর্মার ধর্মীয় বক্তাগণ তাদের উপার্জিত আয় থেকে সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করে দেশ ও সমাজের অগ্রযাত্রায় যুগপৎ অবদান রাখবেন।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির ওপর যথাযথ দৃষ্টিপাত করবেন বলে আশা করি। ধন্যবাদ।