মহর আলীর মেয়ে কুসুমের একটি ভিডিও গ্রামের ছেলেদের মোবাইলে ছড়িয়ে পড়েছে। গোসলের ভিডিও। ভিডিওটি গোপনে করা হয়নি, কুসুমের সামনেই করা হয়েছে। কলপাড়ে গোসলের সময় গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে নিজেকে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু খুব একটা আড়ষ্টতা ছিল না ওর হাবভাবে। সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও যে করেছে তার সঙ্গে হেসে হেসে কথাও বলেছে।
বাচ্চা মেয়ে, বয়স বড়জোর তের-চৌদ্দ। স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। লম্বা ধিঙ্গি গড়ন, যখন হাঁটে—নিজেকে প্রকাশের সদিচ্ছা মোটেও লুকানোর চেষ্টা করে না। গরিবের মেয়ে বলেই কিনা, চক্ষুলজ্জা জিনিসটা ছোট থেকেই খুব একটা চোখে উঠেনি। তা ছাড়া, এখন ওর যে বয়স, নিজেকে নিয়ে এ বয়সের মেয়েদের মনে নানা কৌতূহল তৈরি হয়। কৈশোরের খোলস থেকে শরীর নতুন এক অবয়বে খোলতাই হতে শুরু করে। এ নতুনত্ব অন্যকে দেখানোর মধ্যে গোপন আনন্দ আছে। সেই গোপন আনন্দ ঘনিষ্ঠ কারো সঙ্গে উদযাপনের সময় মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও করেছিল। সেটা কীভাবে কীভাবে যেন গ্রামের ছেলেদের মোবাইলে ছড়িয়ে গেছে।
কুসুমের বাবা মহর আলী ঘটনা জানতে পেরে মেয়েকে দু-চারটে থাপ্পড় মেরেছিল। পরদিন সকালবেলা মেয়ে বাড়ি থেকে হাওয়া। কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে—
ও নিয়ে পাড়ায় দু-চারজন কথা বললেও গ্রামজুড়ে খবরটা বড় একটা চাউড় হলো না। বাউতলা গ্রামে কোনো হাট বা বাজার নেই, খবর চাউড় হতে তাই সময় লাগে। গ্রামের ওপর দিয়ে বড় কোনো রাস্তাও যায়নি, বাস স্ট্যান্ড থাকলে তবু দু-চারটে চায়ের দোকান উঠতো, তা-ও নেই। গ্রামের মাঝখানে তিন রাস্তার মোড়ে পবন বানিয়ার মুদি দোকান, সেটাই খবর ছড়ানোর প্রধান কেন্দ্র।
পবন বানিয়ার দোকানে মাস দুয়েক আগে ইন্টারনেটের রাউটার লাগানো হয়েছে। রাউটার থেকে মোবাইলে কানেকশনপ্রতি মাসকাবারি একশ টাকা করে রাখে পবন। পাড়ার উঠতি ছেলেরা সারাদিন দোকানের চারপাশে বসে-দাঁড়িয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকে। ফেসবুক, ইউটিউব, নানা পর্নো সাইটে সারাদিন শত শত বিদেশি মেয়ের ক্লিভেজ দেখে ক্লান্ত যে ছেলেরা, তারা কুসুমের ওইটুকু গোসলের ভিডিওর ব্যাপ্তি আর কতক্ষণ মনে রাখবে! ওরা নিজেরা নিজেরা দু-একদিন আলাপ করেছিল, সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতে সবাই ভুলেই গেল কুসুমের ওই স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিওর কথা। দু-চারজন মুখ টিপে আলাপ জারি রেখেছিল এর ওর সঙ্গে, কিন্তু সেটা ওই আড়ালে আবডালে; দেনদরবার হওয়ার মতো জমল না খবরটা। তবে ঘটনাটা যেহেতু উঠতি বয়সী এক মেয়ের, প্রমাণ আকারের একটা ক্ষত রেখে গেল গ্রামের স্বাভাবিক ঘটমান জীবনে।
দুই
সন্ধ্যার একটু পরে মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন কৃষ্ণপুর মা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে বসে নিজেদের মহিলা মাদরাসার প্রশ্ন কম্পোজ করাচ্ছিল। এমন সময় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে একটি মেয়ে ঢুকল দোকানে। এদিক সেদিক একবার তাকিয়ে মামুনের পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়ল। দোকানে খুব একটা লোকজন নেই। ফটোকপির জন্য দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ফটোকপি মেশিনের সামনে, সেখানে দোকানের অপারেটর হাবিব একমনে ফটোকপি করছে। মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। সারা দিন শত শত মেয়ে আসে নানা কাজে, দু-চারজনের দিকে নজর না দিলেও চলে।
দোকানের এ পাশটায় বাল্বের আলো খানিকটা কম। মেয়েটি চেয়ার টেনে মামুনের আরেকটু কাছে এসে বসল। মামুন কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলেও পাশ ঘেঁষে বসা মেয়েটির নড়াচড়া বুঝতে পারছিল। কাছে এসে বসতেই ভেতরে ভেতরে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল।
প্রশ্ন কম্পোজ করছিল যে ছেলেটা, ওর নাম ফজলু। কাস্টমার মনে করে ফজলু অভ্যাশবশত জিজ্ঞেস করল, ‘কী লাগবে আপনার, আপা?’
মেয়েটি মাথার ওড়না একটু সরিয়ে আস্তে করে বলল, ‘কিছু না।’ মামুনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘মামুন ভাই, আমি কুসুম!’
মামুন ভ্রু কুঁচকে শূন্য দৃষ্টিতে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কুসুম, তুই? তুই কী জন্য এখানে?’
কুসুমের ভিডিও-কাণ্ডের কথা মামুনও শুনেছে। গ্রামের ইমাম সাহেব হলে এলাকার ঘটন-অঘটন সব খবরই অল্প বিস্তর কানে আসে। আর সে যদি বয়সে যুবক হয়, গ্রামের যুবক ছেলেপেলে এমনিতেই তার মুরিদ হয়ে যায়। এই মুরিদ বাহিনীর কাজ হচ্ছে, নামাজের আগে পরে ইমাম সাহেবের কামরায় এসে গ্রামের ঘটে যাওয়া প্রতিদিনকার নানা ঘটনার কোষ্ঠি বিচার করা। ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে কার গোয়ালে গরুর বাছুর বিয়ালো, কার ছেলের বউ ঠাট দেখিয়ে চলাফেরা করে—সব খবর এখানে এসে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়।
সপ্তাহখানেক আগে কুসুমের ঘটনা মামুন নিজের কামরায় বসে শুনেছিল পাড়ার ছেলেদের মুখে। এ নিয়ে বেশ হাসাহাসিও করেছিল কয়েকজন। খবরটা শুনে মামুনের বেশ খারাপ লেগেছিল। কুসুমের মতো একটা বাচ্চা মেয়ে এমন কাজ কীভাবে করতে পারল? ও কি এখন সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল মেয়েটার! বিষয়টা মনের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ঘুরপাক খেয়েছে। আজকেও কৃষ্ণপুর আসার সময় কুসুমদের বাড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময় মনে হয়েছিল ঘটনাটা।
কিন্তু এই সন্ধ্যায় কুসুমকে দেখে মামুনের মনে হল, কই, কিছুই তো নষ্ট হয়নি। কুসুম সেই আগের কুসুমই আছে। গায়ে ঘিয়ে রঙের সালোয়ার-কামিজ, মাথায় জড়ানো লাল রংয়ের ওড়নায় ঢাকা কুসুমের শ্যামলা মুখে তো কলঙ্কের কোনো কালি নেই! ওর সামনে বসেই এখন কথা বলছে, কুসুমের কথায় তো কোনো ছুৎমার্গের শুচিতা নেই।
‘আপনের সঙ্গে একটু কথা বলবো।’
মামুন দোকানের ভেতরটা একবার দেখে নিয়ে কুসুমকে একটু সরে বসতে বলল। নিজের চেয়ারটা ফজলুর কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে এনে বসল। মামুনের মন থেকে আড়ষ্ট ভাব এখনও পুরোপুরি যায়নি। ঘটনাটা বার বার মনে উঁকি দিচ্ছে। নিজের মধ্যেই কেমন যেন একটা গ্লানি তৈরি হচ্ছে। চোখ তুলে সরাসরি কুসুমের দিকে তাকাতে পারছে না। ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং এখনকার আকস্মিকতায় কিছুটা বিব্রত।
‘বল, কী বলবি।’
‘মামুন ভাই, আসলে কীভাবে বলব…!’ কুসুম থেমে যায়। এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙুল নাড়াচাড়া করছে। কুসুম আসলে কী বলতে ওর কাছে এসেছে, সে ব্যাপারে মামুনের ধারণা নেই। তবে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে যে ও যথেষ্ট বিব্রত সেটা ওর হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে।
‘বলে ফেল, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো তোর বড় ভাইয়ের মতো, তাই না?
কুসুমের চোখে জল টলমল করে ওঠে, ‘আব্বা সেদিন আমারে অনেক মারছে, অনেক রাগারাগি করছে। আব্বা জীবনে আমার গায়ে হাত তুলে নাই। আব্বার হাতের মার খেয়ে কষ্টে আমি বাড়ি থেকে চইলা আসছিলাম।’ চোখের টলমল জল গাল বেয়ে নামতে শুরু করে, ‘কিন্তু আমি কী দোষ করছিলাম, বলেন? ভিডিও করছিল ফাতেমা। ও ওর ভাই ফরিদের মোবাইল নিয়া আমাদের বাড়িতে আসছিল, আমি তখন গোসল করতেছিলাম। ও দুষ্টুমি কইরা আমার ভিডিও করে, বলছিল পরে ডিলিট কইরা দিবে। কিন্তু পরে আর ডিলিট করতে মনে নাই, ফরিদ ভাই মোবাইল নিয়া যায়। ফরিদ ভাই-ই ভিডিওটা সবাইরে দেখাইছে।’
কুসুম ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে। ওকে কাঁদতে দেখে মামুনের মনটা আনচান করে ওঠে, ‘আরে, কানতেছিস কেন? যা হওয়ার হইছে, এখন আর কান্দিস না। এ কয়দিন তুই ছিলি কই?’
‘বলিভদ্র, আমার খালাত বোন শিউলীর কাছে। ও রপ্তানিতে কাজ করে, আমিও ওর সঙ্গে গার্মেন্টসে চাকরি নিছি।’
‘আরে, বলিস কি! এরই মধ্যে গার্মেন্টসে চাকরিও নিয়া নিছস?’
‘কী করব, আব্বার ওপর রাগ কইরাই চাকরি নিছি। আব্বা আসল সত্যটা আমার কাছে একবার শুনতেও চাইল না। সোজা বইলা দিল—কাল সকালে যেন তোর মুখ আমি না দেখি! নিজের বাপের মুখে এমন কথা শোনার চেয়ে মইরা যাওয়া ভালো। আমি তো এখন কলঙ্কিনী, সমাজের সবার কাছে খারাপ মেয়ে। আমার তো কাউরে আর মুখ দেখানোর উপায় নাই। যদি মইরা যাইতে পারতাম তাহলে সবচেয়ে ভালো হইতো।’
মামুনের ভেতরটা শিউরে ওঠে। এইটুকুন মেয়ে এত কঠিন কঠিন কথা কই থেকে শিখল? জীবনের চরম বাস্তবতা মনে হয় এভাবেই মানুষকে পরিণত করে তোলে।
ওর মনে নতুন একটা চিন্তা এল, ঘটনা যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে কুসুমের অপরাধটা কোথায়? একজন মাওলানা হিসেবে মামুনের মনে ধর্মের দিকটাই আগে আসে। ইসলামের দৃষ্টিতে কি কুসুম অপরাধী? দুই বান্ধবী নিতান্তই দুষ্টুমি করে গোসলের দৃশ্য ভিডিও করেছে। ছোট মানুষ, এমন কৌতূহল হতেই পারে। কাউকে দেখানোর জন্য তো ভিডিও করেনি। ভুল করে ভিডিওটা ফাতেমার ভাই ফরিদ দেখে ফেলে এবং সেটা সে আরও অনেককে দেখায়, অনেকের মোবাইলে শেয়ার করে। আসল দোষী তো ফরিদ। তাহলে কুসুমকে কেন খারাপ ভাবা হবে? সে মেয়ে বলে? ছুৎমার্গ কি কেবল নারীর শরীরেই লেগে থাকে?
‘যা হওয়ার হইছে, এখন বাড়ি যা। কাক্কারে আমি বুঝায়া বলবোনে।’
‘না মামুন ভাই, আমি বাড়ি যাবো না। আমি আপনের কাছে আসছি শুধু আব্বারে এইটা বলতে, আব্বায় যেন আমারে ভুল না বুঝে। আপনি আব্বারে বুঝায়া বলবেন, আমি এমন কোনো পাপ করি নাই যার কারণে আমার মুখ সে দেখতে পারবে না। যদি আমার মুখ দেখতে না-ই চায় তাহলে আমি আর জীবনে কাউতলা যাবো না, আমার মুখও কাউকে দেখাবো না… সবাই আমার মরা মুখ দেখবে।’
এতক্ষণ নীরব কান্না ছিল, এবার সেটা উপচে পড়ল। কুসুম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
‘পাগলামি করিস না কুসুম, আমার কথা শোন। যা ঘটছে তা এমন বড় কিছু না। গ্রামের মানুষ তা দুদিনেই ভুলে গেছে। কাক্কাও হয়তো রাগের মাথায় তখন মুখে যা আসছে তাই বলছে, বুঝিয়ে বললে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই এখানে বস, আমি কাজটা শেষ করে তোকে বাড়ি দিয়ে আসব।’
‘না মামুন ভাই, আমি বাড়িতে যাব না। আপনে শুধু আব্বারে বইলেন…।’
মামুন হাত উঁচু করে ওকে থামিয়ে দেয়, ‘আর একটা কথাও বলবি না। কাক্কারে কীভাবে বুঝাতে হবে সেটা আমার ব্যাপার। চিন্তা করিস না।’
‘মামুন ভাই, আপনে আমার কথা শোনেন…।’
‘কোনো কথা নাই, বস এখানে।’
মামুন চেয়ার থেকে উঠে ফজলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফজলু, তুমি প্রশ্নগুলা কম্পোজ করে রাইখো, আমি কালকে এসে সব দেখে নিয়ে যাবো।’ কুসুমকে বলল, ‘চল।’
কুসুম আরও দু-একবার না করল, কিন্তু মামুন ওকে জোর করে বাইরে নিয়ে এসে বাউতলার একটা অটোতে চড়ে বসল।
তিন
কুসুমের ছোট ভাই নয়ন বারান্দায় বসে স্কুলের পড়া পড়ছিল একমনে। মামুনের সঙ্গে কুসুমকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে চিৎকার দিয়ে ছুটে এল। ‘কুসুম আপা আসছে, কুসুম আপা…’ বলতে বলতে বোনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কুসুম ভাইকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু মনের মধ্যে অজানা ভয়ও কাজ করছিল। ‘তুমি কই আছিলা আপা? তোমার জন্য আমি অনেক কানছি, মা-ও কানছে; তুমি এতদিন আসো নাই কেন…?’ নয়ন একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কুসুম চোখে জল নিয়ে অগোছালোভাবে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে।
ঘর থেকে কুসুমের মা কুলসুম আর ওর বাবা মহর আলী বের হয়ে এসেছে। কুলসুম একবার ভয়ে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার চাপা আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছে মেয়ের দিকে। দুয়ারে কুসুমের পাশে দাঁড়ানো মসজিদের ইমাম মাওলানা মামুনকে দেখে মনে অনেকটা বল পাচ্ছে—খারাপ কিছু ঘটবে না।
মহর আলীকে বেরোতে দেখে মামুন এগিয়ে আসে, ‘কাক্কা, কেমন আছেন?’
‘এই তো, ভালো। আসো, বসো।’ মহর আলী বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দেয়।
‘না কাক্কা, এখন বসব না বেশিক্ষণ, নামাজের সময় হয়ে গেছে প্রায়। আপনে বসেন।’ এই বলে মামুন মহর আলীর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে নিজে আরেকটা চেয়ার টেনে নেয়। ‘কাক্কা, ঘটনা যা হয়েছে সেটা আমি শুনছি। সেটা নিয়ে আর কথা বলার দরকার নাই। তবে ওই ঘটনার জন্য কুসুম মোটেও দায়ী না। ও ছোট মানুষ, না বুঝে কৌতূহলবশত কাজটা করছে। এরকম তো অনেকেই করে। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে—দুষ্টুমি করে করা ভিডিওটা অন্য অনেকের মোবাইলে চলে গেছে। সে কাজটা তো আর ও করেনি। সেটা করেছে ফাতেমার ভাই ফরিদ। সে শয়তানি করে এটা গ্রামের পোলাপানের মোবাইলে দিয়ে দিছে। দোষ যদি হয় তবে সেটা ফরিদের, কুসুমের তো কোনো দোষ নাই।’
মহর আলী চুপ করে থাকে, কী বলবে ভেবে পায় না। বাবা-হৃদয়ের পাথর গলছে বুঝতে পেরে মামুন আরেকটু যোগ করে, ‘কাক্কা, কুসুমরে আপনে আর কিছু বইলেন না। এমনিতেই ছোট মেয়ে, আপনি রাগ করলে ছোট মনে কী করতে কী করে ফেলে বলা যায় না। পরে দেখা যাবে, সামান্য বিষয়ের কারণে ওর পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে…।’
‘জীবন কি এখন আর নষ্ট হইতে বাকি আছে বাবা!’ মামুনের কথার মাঝখানে বলে ওঠে মহর আলী। কথার মাঝে খেদ, পরাজয়ের হতাশা। ‘কোনো মেয়ের গায়ে একবার কলঙ্কের কালি লাগলে সেই দাগ সহজে উঠে না।’
মহর আলীর কথায় মামুনের রাগই হলো। একজন মেয়ের বাবা হয়ে কীভাবে তিনি এত সহজে মেয়েকে কলঙ্কের দাগে দণ্ডিত করতে পারেন? ‘এসব কী বলেন আপনে, কাক্কা! এই সামান্য বিষয় নিয়ে কলঙ্ক দাগ—এগুলো কোনো কথার কথা হলো? এসব বিষয় আজকে হয়তো দুই-চারজন বলাবলি করছে, দুদিন বাদে সবাই ভুলে যাবে।’
‘তুমি যাই বলো মামুন, এই মেয়েকে বাড়িতে জায়গা দিলে আমি গ্রামের মানুষের সামনে মুখ দেখাইতে পারুম না। আমি গরিব হইতে পারি, কিন্তু মেয়ের কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়া রাস্তায় চলতে পারব না। মানুষ নিজের বাপের মরামুখ ভুইলা যাইতে পারে, একজন মেয়ের কলঙ্ক সহজে ভুলে না। ওরে বইলা দেও, আমার বাড়িতে ওর কোনো জায়গা হবে না।’
মামুন মসজিদের ইমাম হলেও গ্রামের ছেলে, গ্রামের সবার ভাই বা ভাতিজা। এ কারণে সে মনে করেছিল মহর চাচা তার কথা ফেলতে পারবে না। হাজার হলেও নিজের বড় মেয়ে, অকূলে তো আর ভাসিয়ে দেবে না। কিন্তু মহর আলীর কথা শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষের মনে সামাজিক কুসংস্কার-ভীতি এখনও এতটা প্রকটভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে—সে কখনো চিন্তাই করেনি।
মামুন নিজের রাগটা এতক্ষণ দমিয়ে রেখেছিল, এবার সেটা প্রকাশ হল। সে মহর আলীর সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আপনার মেয়েকে আপনে যদি ঘরে জায়গা না-ই দেন, সমাজের মানুষের ভয়ে যদি তাকে বাড়িতে উঠাতে ভয় পান তবে আমিই তাকে জায়গা দিব। সে আমাদের মহিলা মাদরাসায় থাকবে। যদি কোনোদিন মনে করেন মেয়ের কলঙ্কের পাপ প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে, তখন ওর পায়ে ধরে মাফ চেয়ে তারপর ওকে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। আমি ওকে নিয়ে যাইতেছি। এ্যাই কুসুম, আয় আমার সঙ্গে।’ মামুন দুয়ারে দাঁড়ানো কুসুমের হাত ধরে মহর আলীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
চার
এমন খবর চাপা থাকে না। পরদিনই কুসুমের প্রত্যাবর্তনের খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। কুসুমের ফিরে আসার চেয়ে বেশি চাউর হল মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন কর্তৃক তাকে মাদরাসায় জায়গা দেয়ার খবর। পবন বানিয়ার দোকানে দুপুরের আগেই বেশ কয়েক প্রস্থ আলোচনা হয়ে গেল এ নিয়ে। অবশ্য খুব একটা জোরেশোরে আলোচনা করা যাচ্ছে না। কেননা মামুনের বাবা আবদুল লতিফ বেপারী গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ। যৌবনে নামাজ-কালামের ধার ধারতেন না বড় একটা। কিন্তু ছেলে মাদরাসায় পড়ার কারণে বছর কয়েক হল তাবলিগ করে তিনিও ধর্মে কর্মে মন দিয়েছেন। মামুন তার একমাত্র ছেলে, দূরে কোথাও চাকরি-বাকরি করলে তার খেত-খোলা কে দেখবে—এমন চিন্তা থেকে বাড়ির পাশে মহিলা মাদরাসা চালু করে দিয়েছেন। ছেলে প্রথমে রাজি না হলেও মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাদরাসা আর গ্রামের মসজিদে থিতু হয়েছে।
এলাকার লোকজন কুসুমের ফিরে আসা নিয়ে বাঁকা কথা বলতে চাইলে সেটা মসজিদের ইমাম আর মহিলা মাদরাসাকে ছুঁইয়ে বলতে হবে। কিন্তু এ দুটোই স্পর্শকাতর বিষয়। ফলে কুসুমের ফিরে আসা নিয়ে আলোচনা নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে থমকে যাচ্ছে, কেউ আর বড় একটা এগুতে পারছে না। প্রথম বাধটা ভাঙলেন মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি করিম মিয়া।
জোহরের নামাজের পর মসজিদের মুসল্লি যখন কমতির দিকে, আট-দশজন তসবিহ-জিকির নিয়ে অলস বসে আছেন, তখন করিম মিয়া ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মহর আলীর মেয়ে কুসুম নাকি আসছে শুনলাম?’
মামুন জানে, তাকে কিছু কথার জবাব দিতে হবে। সে জবাবগুলো আগেই তৈরি করে রেখেছে। ‘জি চাচা, মহিলা মাদরাসায় আছে। ওদের বাড়িতে ওর আব্বা রাগ-টাগ করছে তো, তাই আপাতত কয়েকটা দিন মাদরাসায় থাকবে।’
‘ও আচ্ছা! কিন্তু ওরে নিয়া সপ্তাহখানেক ধইরা কী জানি কথাবার্তা শুনতেছি…।’
‘ওই পোলাপান মানুষ তো, একটু ভুল-চুক হয়া যায় আর কি। সেটা শুধরানোর জন্যই মাদরাসায় চলে আসছে।’
‘সেইটা ঠিক আছে, তবে মাদরাসায় তো দশ মায়ের দশ মেয়ে থাকে, বুঝলা? শুধরাইতে গিয়া আবার দেইখো বেড়ায় না খেত খাইয়া ফালায়।’
মসজিদে বসা অন্য মুসল্লিরাও এ-কথা সে-কথা বলতে লাগলেন। ইতিবাচক কথা কেউ ভুলেও মুখে আনলেন না। ঠাট্টা-মশকরা আর টিপ্পনীও করতে লাগলেন অনেকে। মামুনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মানুষগুলো বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়ে আসছে, তাবলিগ করে, চিল্লায় যায়, ওয়াজ শোনে, তালিম করে; নিজেদের হেদায়েতের জন্য কত আয়োজন তাদের। নিজেদের পাপমোচনের জন্য নামাজের পর জর্জর হয়ে কাঁদেন কেউ কেউ। তাহলে একটা মেয়ে নিজের সামান্য ভুল শুধরানোর সুযোগ পাবে না কেন? মেয়ের গায়ে একবার কলঙ্ক লাগলে সেটা আজীবন আর মোচন হয় না? এর নাম কি ধর্ম? ইসলাম কি এতই কৃপণ যে একজন সামান্য স্কুলছাত্রীর পাপমোচনে নিরুপায় হয়ে যাবে?
একটা মেয়ে এতদিন উগ্রভাবে চলাফেরা করেছে, গ্রামের কেউ তাকে কিছু বলেনি, কেউ তাকে শুধরানো বা শাসন করতে যায়নি। কিন্তু মেয়েটা যখন কোনো ভুল করে বসল তখন সবাই তামাশা দেখেছে। সবার চোখে ধরা পড়েছে শুধু তার কালির মতো কালো কলঙ্ক। তার ভেতরে আর কোনো আলো নেই, শুধুই অন্ধকারময় তার জীবন। আজীবনের জন্য সে নষ্ট হয়ে গেছে। তার বিয়ে হবে না, সমাজে মান-সম্মান থাকবে না। সমাজ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে হবে। সারা জীবনেও তার সে কলঙ্কের দাগ দূর হতে দেবে না এ সমাজ। আমাদের বকধার্মিক সমাজ আর কখনো তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। কী আশ্চর্য আমাদের সামাজিকতা!
কিন্তু একটা ছেলে যদি খারাপ হয়, তার চরিত্রে শত শত কলঙ্কের দাগ পড়ার পরও যদি সে ভালো হয়ে যায় তবে একসময় সে সকলের কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে ওঠে। সমাজের সবাই তাকে বাহবা দিতে থাকে। ধর্ম-কর্ম করে একসময় সে বড় ধার্মিকও হতে পারে, সমাজের নেতা হতে পারে, মান্যজন হতে পারে; তাহলে একজন মেয়ের জন্য কেন এই অবিচার? সে ভালো হলে সমাজ কেন তাকে গ্রহণ করতে পারে না? এ দোষ কি মেয়েটার, নাকি আমাদের সমাজে মেয়েদের নিয়ে লালিত নীচ মানসিকতার? আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ খুব সহজেই হয়তো একটি মেয়ের সকল পাপ ক্ষমা করে দেন, কিন্তু আমাদের কলুষিত মানসিকতা কখনো একটি মেয়ের ভুলকে ক্ষমা করে না। জীবনভর আমরা সেটা মনে রাখি এবং তাকে আজীবন সেই পাপের বোঝা দিয়েই পরিমাপ করি। আমরা কি আল্লাহর চেয়ে কঠোর হয়ে গেছি? আমাদের কাছে কি একজন পাপী মেয়ে ক্ষমা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখে না? এতটাই পাষাণ আমাদের হৃদয়।
পরদিন ফজরের নামাজের পর মামুন জানতে পারল, ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে কুসুম মাদরাসা থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে, বলে যায়নি। জীবনের আন্তঃনগর ট্রেন থেকে ছিটকে পড়া কিশোরী, আবার জীবনের পথে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। হয়তো লাখ লাখ পোশাককন্যার একজন হয়ে জীবনের ঘানি তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে। অথবা সামাজিক অপমানের পাষ- পেষণ নিয়ে গেছে আরও অন্ধকার কোনো অতলে, কে জানে। হয়তো জীবনের কোনো এক বাঁকে কুসুম আবার একদিন মামুনকে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলবে, ‘মামুন ভাই, আমি কুসুম। আপনের লগে একটু কথা আছে!’
প্রকাশিত : অন্যপরশ