আতিকা বিনতে জায়েদ যথেষ্ট রূপবতী। মদিনা নারীমহলে তার রূপের বেশ পেহচান আছে। এ নিয়ে আতিকার যদিও তেমন কোনো অহম নেই, তবে তার স্বামী যখন বিমুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন তখন বুকের মধ্যে কেমন যেনো অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। এ ভালোলাগা বলে বুঝানো যায় না।

বিয়ে হয়েছে কিছুদিন হলো। স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর আতিকা বলতে পাগল। সারাটা দিন প্রায় বউয়ের আঁচলতলেই কাটে তাঁর।

কেবল রূপ নয়, ঘটে যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধিও রাখেন তিনি। তাছাড়া বংশীয় সম্মানও তার কম নয়। স্বর্গ-সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি সায়িদ ইবনে জায়েদ তাঁর আপন ভাই এবং উমর ইবনে খাত্তাব তার চাচাতো ভাই। তিনি নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেন নবুওয়াতের সূচনাকালেই, একেবারে কিশোরী বয়সে।

স্বামী-স্ত্রী একে অপরের ভালোবাসায় বেচাইন। এমন সময় রাসুল মুহাম্মদ সা.-এর পক্ষ থেকে এক অভিযানে অংশগ্রহণ করার ডাক এলো। অভিযান ততোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না বিধায় আবদুল্লাহ এ যাত্রায় গেলেন না। স্ত্রীর ভালোবাসার বাহুডোর তাকে আটকে রাখলো মদিনার খর্জুরবিথীর ছাউনির তলে।

অভিযান শেষে পিতা আবু বকর রাদি. মদিনায় ফিরে এসেই ছেলে আবদুল্লাহকে ডেকে জানতে চাইলেন কেন তিনি অভিযানে শরিক হলেন না। আবদুল্লাহ লা-জওয়াব। আবু বকর ক্ষুব্ধ হলেন দারুণ। রেগে উঠলেন ছেলে ও ছেলেবৌয়ের ওপর। ছেলেকে তখনই নির্দেশ দিলেন- যে স্ত্রীর কারণে তুমি রাসুলের সঙ্গে জিহাদে যেতে পারোনি, সেই স্ত্রীকে তোমার তালাক দিতে হবে। কেননা রাসুলের ভালোবাসার চাইতে অন্যকারো ভালোবাসা প্রাধান্য পেতে পারে না।

আবদুল্লাহ হকচকিয়ে গেলেন। ভীত হয়ে পড়লেন। ব্যাপারটি যে এমন ভয়াবহভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা তিনি মোটেও ভাবেননি। তিনি কাপুরুষ নন মোটেও, এ প্রমাণ তিনি অতীতে বহুবার দিয়েছেন। মূলত অভিযানের গুরুত্ব কম থাকার কারণেই তিনি স্ত্রীসঙ্গকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা যে বিষয়টিকে এতো কঠিন করে ভাববেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি।

তিনি অনন্যোপায়- একদিকে পিতার আদেশ, অন্যদিকে প্রিয়তমা স্ত্রীর রোদনভরা মুখচ্ছবি। নিজের অপারগতার বিষয়টি বাবা আবু বকরকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন- অভিযানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত একান্তই তার। এখানে তার স্ত্রী আতিকার কোনো দোষ নেই। সে নির্দোষ। অপরাধ যদি হয়ে থাকে তাহলে সে অপরাধের অপরাধী সে। তাকে যে শাস্তিই দেয়া হোক, সে মাথা পেতে নেবে। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রতি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত যেনো না নেয়া হয়।

আয়রন হার্ট আবু বকর নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তিনি কিছুতেই রাসুলের আদেশের অবজ্ঞা মেনে নিতে পারবেন না। যে রাসুলের জন্য তিনি জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন, ছেড়ে এসেছেন মাতৃভূমি, তার ছেলে হয়ে সেই রাসুলের প্রতি ভালোবাসার সামান্য অপরিণামদর্শিতা দেখাবে, এটা তিনি বরদাশত করবেন না।

আবদুল্লাহ বারবার পিতার কাছে মিনতি করলেন। ক্ষমার আরজু করলেন। কিন্তু আবু বকর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।

আবদুল্লাহর ভালোবাসা পরাজিত হলো। পিতার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিলেন। প্রিয়তমা আতিকার ভালোবাসা বুকের মধ্যে দাফন করে বিচ্ছেদের নিশান উড়িয়ে দিলেন হৃদয় জমিনে। অল্পদিনের গভীর প্রেমের বাঁধন ছিন্ন করে স্ত্রী আতিকাকে অন্তবর্তীকালীন (এক) তালাক দিলেন।

পিতার আদেশ মেনে তালাক তো দিলেন, মুখে যদিও উচ্চারণ করলেন তালাকবাণী; কিন্তু হৃদয়ের বন্ধন কীভাবে ছিড়ে ফেলবেন? রক্তের আকর দিয়ে লিখেছেন যার নাম, এতো সহজেই কি হৃদয় মেনে নেবে এ জুদায়ি? ব্যথাভরা অন্তর নিয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলেন আর অশ্রুর জল মিশিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলেন-

আতিকা আমার!
এ সূর্য যতোদিন আলো দেবে পৃথিবীতে
যতোদিন কুমারী পায়রার দল বাক বাকুম বলে কাঁদবে
আমি তোমাকে ভুলবো না আতিকা!
হৃদয়ের অস্পর্শী জমিনে তুমি আছো, দিন-রাত তোমার বিচরণ 
তোমাকেই চাই, শতবার এ হৃদয় জমিনে
আমার মতো নিঃস্বজন কেমন করে তোমা থেকে জুদা হই
তোমার মতো নিষ্পাপ গোলাপকে কেমন করে বলি- তালাক!

আবদুল্লাহর এমন প্রেমবিরহ, আতিকার বিচ্ছেদব্যথা তার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-স্বজন সবাইকে ভাবিয়ে তুললো। অবশেষে তাঁর এমন তড়পানো দহনের সংবাদ পিতা আবু বকরের কানেও গেলো। তিনি পুত্রের প্রেমিক হৃদয়ের এমন আহাজারি শুনে মুখ টিপে হাসলেন। এবং ছেলে এবং ছেলেবৌয়ের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন। আবদুল্লাহকে ডেকে অন্তর্বর্তীকালীন তালাক ফিরিয়ে নিতে বললেন। আতিকাকে ফের ঘরে আনার অনুমতি দিয়ে দুজনকে বরণ করে নিলেন।

 

সূত্র: সংগ্রামী নারী, লেখক: মুহাম্মদ নূরুযযামান