কিছুক্ষণ আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনলাইন বিজ্ঞান জার্নালে মহাকাশ নিয়ে চমকপ্রদ একটা সংবাদ দেখলাম। পৃথিবী থেকে সাড়ে সাত বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর (Black hole)।

চমকে দেয়ার মতো ঘটনা হলো, এই ব্ল্যাক হোলটি এতই বিশাল, আমাদের পৃথিবী তো নস্যি, বরং এটি আকারে সূর্যের চেয়েও ২০ মিলিয়ন গুণ বেশি বড়। চিন্তা করতে পারছেন? সূর্য আমাদের পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। সেই সূর্যের চেয়ে এই ব্ল্যাক হোলের ব্যাপ্তি দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) গুণ বড়! পাঁচ হাজার লিটার পানির ট্যাংকের পাশে একটি সরিষার দানা যেমন।

ব্ল্যাক হোল আসলে কী, মহাকাশ-বিজ্ঞান বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জানি, মহাকাশের কোনো শূন্য স্থানে যখন অনেক বেশি শক্তি বা ভর কেন্দ্রীভূত হয় তখন সেখানে একটি ঘূর্ণয়মান গহ্বর বা গর্তের তৈরি হয়। এই গহ্বর এতটাই শক্তিশালী হয়, এটা তার আশপাশের গ্রহ-নক্ষত্র সব তার ভেতরে অদৃশ্য করে ফেলে। এমনকি এটি আলো (Light) এবং সময়কেও (Time) গ্রাস করে ফেলতে পারে। থিউরিটিক্যালি বলায় হয়, ব্ল্যাক হোলের ভেতরে যদি কোনো মানুষ কখনো চলে যায় তবে তার সময়ের গতি ধীর হয়ে যাবে।

উইকিপিডিয়া বিষয়টি আরও সহজ করে বলছে, আমরা মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠে কল্পনা করি। মহাবিশ্বকে চিন্তা করুন একটি বিশাল কাপড়ের টুকরো হিসেবে এবং তারপর যদি আপনি কাপড়ের উপর কোনো কোনো স্থানে কিছু ভারী বস্তু রাখেন তাহলে কী দেখবেন? যেসব স্থানে ভারী বস্তু রয়েছে সেসব স্থানের কাপড় একটু নিচু হয়ে গিয়েছে। এই একই ব্যাপারটি ঘটে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। যেসব স্থানে ভর অচিন্তনীয় পরিমাণ বেশি সেসব স্থানে গর্ত হয়ে আছে। এই অসামান্য ভর এক স্থানে কুন্ডলিত হয়ে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি গ্যালাক্সির স্থানে স্থানে কম-বেশি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সাধারণত বেশিরভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণয়মান।

দুই

এখানে আমি দুটো বিষয় নিয়ে কথা বলব।

ক. ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে ঢুকে গেলে সময়ের গতি ধীর হয়ে যাওয়ার যে তত্ত্ব, সেটি সাইন্টিফিক্যালি গ্রহণযোগ্য। তবে এর ভেতরে সময়ের গতি কতটা ধীর হবে কিংবা একেকটি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে সময়ের গতি ভিন্ন ভিন্ন কি-না, সেটি এখনও নিশ্চিত করে বলা যায়নি। কেননা প্রতিটি ব্ল্যাক হোলের আকার, ভর ও শক্তি সমান নয় বিধায় এর ভেতরের শক্তির চরিত্রও ভিন্ন হতে পারে।

সময়ের গতি ধীর (Slow) হওয়ার বিষয়টি বেশ মজাদার। সময়ের গতি ধীর হওয়া মানে এই নয় যে সবকিছু স্লো মোশনে চলবে, যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়। সময়ের গতি ধীর হওয়া মানে, আপনি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে চলে গেলে সেখানে আপনি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটাচলা করবেন (যদি বেঁচে থাকেন আর কি)! কিন্তু সময় অতিবাহিত হবে খুব ধীরে, আস্তে আস্তে। সেখানকার একটা ঘণ্টা অতিবাহিত হলে ওই একই সময়ে পৃথিবীতে হয়তো একটা বছর কেটে যাবে। কারণ সেখানকার সময়ের চাইতে পৃথিবীর সময় তো ফাস্ট, দ্রুত চলছে। অনেক কল্পবিজ্ঞানী মনে করেন, ব্ল্যাক হোলের মাধ্যমে টাইম ট্রাভেল করাও সম্ভব।

থাক, বিষয়টা বুঝাতে পারলাম কি-না কে জানে! এ বিষয়ে আর বেশি কথা বললে কথা শুধু শুধু পেঁচিয়ে যাবে। আমরা বরং কুরআনের দুটো আয়াত তুলে ধরি। কুরআনে আল্লাহ বলছেন:

یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ مِنَ السَّمَآءِ اِلَی الۡاَرۡضِ ثُمَّ یَعۡرُجُ اِلَیۡهِ فِیۡ یَوۡمٍ کَانَ مِمِقۡدَارُهٗۤ اَلۡفَ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ

‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সকল কার্য পরিচালনা করেন। তারপর তা একদিন তাঁর কাছেই উপস্থাপিত হবে। যেদিনের পরিমাণ হবে তোমাদের গণনায় হাজার বছর।’ সুরা সাজদাহ, আয়াত ৫

وَ اِنَّ یَوۡمًا عِنۡدَ رَبِّکَ کَاَلۡفِ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ

‘আর তোমার রবের নিকট নিশ্চয় এক দিন তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান।’ সুরা হজ্জ, আয়াত ৪৭

এখানে লক্ষ করুন, ‘আমাদের হাজার বছর’-এর সমান ‘আল্লাহর এক দিন’—এর অর্থ কী? তাহলে কি ওই একটা দিন পৃথিবীর হাজার বছরের সমান হবে? মানে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পুরোটা সময় একটা দিনের সমান হবে?

না, বিষয়টি এমন নয়। এখানে আল্লাহ দিন বলতে উদ্দেশ্য নিয়েছেন ‘সময়’। অর্থাৎ তোমাদের পৃথিবীতে এক হাজার বছরে সে ‘সময়’ অতিবাহিত হবে, এখানে সে সময়টা অতিবাহিত হবে এক দিনে। কিভাবে? কিভাবে হবে—সে বিষয়টিই আমরা উপরে আলোচনা করলাম। ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে সময়ের গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি যদি কিছুটা পরিমাণ বুঝে থাকেন তাহলে এ আয়াতের গুঢ়ার্থ সহজেই বুঝে যাবেন।

খ. এখন পর্যন্ত মানুষের আবিষ্কৃত যেসব প্রযুক্তি এবং যেসব প্রযুক্তির ব্যাপারে ফিউচারিস্টিক মানুষ কল্পনা করতে পারছে, কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমেই মানুষ আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতির কোনো মহাকাশযান (Spacecraft/ship) আবিষ্কার করতে পারবে না। যদি তৈরি করতেও পারে তবে মানুষ সেটিতে চড়ে মহাকাশে উড়তে পারবে না। কেননা মানুষের শারীরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে থিউরিটিক্যালি এটি সম্ভব নয়।

তিন

এখন আমার কৌতূহল, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করলেন, তাকে আধুনিক টেকনোলজি ও মহাকাশের বিস্তর জ্ঞান দান করলেন, তাকে কল্পনা করার নানামাত্রিক সক্ষমতা দিলেন। ফলে আজ থেকে এক হাজার বছর আগে মানুষ যা কল্পনাও করতে পারত না, আজ মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি অ্যাডভান্সড টেকনোলজি আবিষ্কার করেছে এবং করেই চলেছে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজ থেকে ১০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত যেসব জিনিস আবিষ্কারের ব্যাপারে কল্পনা করতে পারেননি, মানুষ তার চেয়েও এগিয়ে গিয়েছে। মানুষ সেই অপ্তবাক্য সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছে—মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আল্লাহ এ কারণেই ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেছিলেন, পৃথিবীতে আমি আমার ‘প্রতিনিধি’ পাঠাতে যাচ্ছি।

তাহলে আজ সাড়ে সাত বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের যে ব্ল্যাক হোলের সংবাদ দেখে আমার মন আনচান করে উঠল, আমার এ আনচানের মূল্য কী? আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ সবেমাত্র গ্রহ-নক্ষত্রের নামকরণ করা শুরু করেছিল। এক হাজার বছর পর মানুষ সেসব গ্রহে যাওয়ার জন্য মহাকাশযান তৈরি করছে। মানুষ কি সত্যিই একদিন মহাকাশের সকল গ্রহ-নক্ষত্র চষে বেড়াতে পারবে? আল্লাহ যে মহাকাশের জ্ঞান তাদের দিলেন সেই মহাকাশ জয় করার সাধ্য কি তাদের দেবেন না? আমার বিশ্বাস, আল্লাহ যেহেতু মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাকে অপার মহাবিশ্বের জ্ঞান দান করেছেন, সেই জ্ঞানের বদৌলতে সে একদিন তার সক্ষমতাকে স্পর্শ করতে পারবে। যদি তাই না হয় তাহলে তো জ্ঞানের কোনো ঐশ্বর্যই থাকবে না।

হয়তো আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক শ কিংবা কয়েক হাজার বছর। আমার মৃত্যুর হাজার বছর পর আমার বংশানুক্রমিক ডিএনএ থেকে জন্ম নেয়া আমারই কোনো বংশধর মহাকাশের অজ্ঞাত কোনো গ্রহের পুরোনো কোনো ডাটা সার্ভার ঘাঁটতে ঘাঁটতে হয়তো এ লেখাটি তার চোখে পড়বে। সে মুচকি হেসে মনে মনে বলবে, প্রাচীন যুগের মানুষরা কত অজ্ঞ ছিল!

 


Leave a Reply

Your email address will not be published.