গত ৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে আরাফাত সিয়াম নামে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান (Physics) বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ফেসবুকে দু-একজনের পোস্ট দেখেছিলাম, তখন বিষয়টা নিয়ে ভাববার উৎসাহ পাইনি। পরে সালমান সাদ একটা লিংক দিল যেখানে ওই শিক্ষার্থীর শেষ ফেসবুক পোস্ট উৎকীর্ণ ছিল। ইংরেজিতে লেখা দীর্ঘ পোস্টটি কৌতূহল নিয়েই পড়তে শুরু করলাম। কৌতূহল নিয়ে পড়া শুরু করলেও পড়তে পড়তে একটা সময় ভেতরে ব্যথা অনুভব করলাম। সঙ্গে এক ধরনের অপরাধবোধও জাগল মনের মধ্যে। সেই অপরাধবোধ থেকেই এ লেখা।

 

প্রথম কথা

শুরুতে আমি আরাফাত সিয়ামের আত্মহত্যার কারণটি তার নিজ জবানিতে তিনি যেমনটি তার ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, সেটার সারসংক্ষেপ বলে নেই। এতে পাঠকের এ লেখাটা বুঝতে সুবিধা হবে।

আরাফাত সিয়াম জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। আর আধুনিক ফিজিক্স মানেই মেটাফিজিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিজম, মহাবিশ্বের গঠন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, অণু-পরমাণুর সম্পর্ক, গ্রহ-নাক্ষত্রিক বিশ্লেষণ, বিশাল কসমস ইউনিভার্স, মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ইত্যাদি বিষয় অটোমেটিক্যালি পাঠ্যবিষয়ে চলে আসে। তো, এই ফিজিক্স থেকেই আরাফাতের মহাজাগতিক অনুসন্ধিৎসা তৈরি হয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরও নানা বই-পুস্তক পাঠ করে তিনি এসব বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়েন এবং তার ভেতরে ফিজিক্স ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আপনারা অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, ফিজিক্সের সঙ্গে আধ্যত্মিকতার কী সম্পর্ক? জি, ফিজিক্সের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের বেশ ভালো রকম সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের আলোচনার সামনে এ বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব যদি সম্ভব হয়।

যাই হোক, এই জাগতিক ও মহাজাগতিক দ্বন্দ্ব থেকে তিনি নিজে নিজেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে এর উত্তর খুঁজতে শুরু করেন। বইপাঠ, ইন্টারনেট এবং আরও নানা মাধ্যমে তিনি হয়তো বিষয়গুলো বুঝার চেষ্টা করে থাকবেন। যেহেতু তিনি ইতোমধ্যে মেডিটেশনও শুরু করেছিলেন, তাই বলতে পারি, তিনি ধর্ম ও বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে নানামাত্রিক জ্ঞান ও প্র্যাকটিসে অভ্যস্ত হচ্ছিলেন।

আরাফাতের শেষ পোস্টে তিনি বলেছেন, রোজকার মতো তিনি মেডিটেশন (ধ্যান, তবে তিনি কী পদ্ধতিতে ধ্যান করতেন সে বিষয়টি অজ্ঞাত।) করছিলেন। মেডিটেশনের এক পর্যায়ে তিনি অনুভব করতে পারলেন, তার আত্মা (Soul) তার শরীর থেকে মুক্ত হয়ে অন্য কোনো ডাইমেনশনে (Dimension) চলে গেছে। সেখানে তিনি আশ্চর্য এক মহাবিশ্ব (Universe) দেখতে পেলেন। যা আনন্দ আর মুক্তিতে উচ্ছ্বল। এরপর তিনি আবার তার হলরুমের স্বস্থানে ফিরে আসেন। এবং সম্ভবত এই অভিজ্ঞতার পরই তিনি উল্লেখিত পোস্টটি লিখেন এবং স্বেচ্ছামরণের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি মাত্রই যে অসীম মুক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন, এর পর তার মনে হয়েছে, তার এই নশ্বর দেহ তার অবিনশ্বর আত্মার মুক্তির পথে একটি বাধা। তিনি যদি দেহের এই খাঁচা থেকে তার আত্মাকে মুক্ত করতে পারেন তাহলেই কেবল সেই অনন্ত ইউনিভার্সে পরিভ্রমণ সম্ভব। সুতরাং মৃত্যুই পারে কেবল সেই খাঁচার বাঁধন থেকে তার আত্মাকে মুক্ত করতে।

তিনি তার লেখায় একটি বড় প্রশ্ন করেছেন নিজের প্রতি—জীবন আসলে কী? আবার তিনিই এর উত্তর দিয়েছেন—জীবন কী, এটা জানতে হলে আমাদের প্রথমে মৃত্যুকে জানতে হবে। মৃত্যু কি জীবনের শেষ নাকি অনন্ত এক জীবনের শুরু?

তার লেখার এই ছিল সারসংক্ষেপ।

 

দ্বিতীয় কথা

আরাফাত সিয়াম আত্মহত্যা করেছেন—কাজটি ভালো না মন্দ, এ প্রশ্ন আমার লেখায় গৌণ। আমার অপরাধবোধের জায়গাটা হলো, তিনি যে চিন্তা ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আত্মহত্যা করলেন, তার এই অতিলৌকিক ও অকল্পনীয় চিন্তার জায়গাটা ইসলামের আধ্যাত্মবাদের আলোয় সমাধান করা সম্ভব ছিল। সেটা করতে না পারার অপারগতা আমার অপরাধবোধের কারণ। আমরা যদি ইসলামের আধ্যাত্মবাদকে আধুনিক ফিজিক্স বা বিজ্ঞানের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আরাফাত সিয়ামের মতো এমন অনেক সত্যান্বেষী তরুণকে হতাশার অন্ধকার থেকে তুলে আনতে পারতাম পরম জ্ঞানের আলোকিত রাজপথে। আমরা পারিনি, এটা আমার হতাশা ও অপরাধবোধের জায়গা।

আমরা কেবল একজন আরাফাত সিয়ামের কথা জানতে পারলাম, সেটাও তার স্বেচ্ছামরণের পর। কিন্তু এমন আরও হাজার হাজার মেধাবী তরুণ রয়েছেন যারা এই একই রকম প্রশ্ন ও একই সিম্পটমে আক্রান্ত হয়ে হয়তো নাস্তিক হয়ে যাচ্ছেন নয়তো বিশ্বাসের দোলাচলে পড়ে অর্ধমৃত হয়ে কাটাচ্ছেন জীবন। বিশ্বাসের ভঙ্গুরতা অত্যন্ত মারাত্মক জিনিস। কেউ যদি জীবনের উদ্দেশ্য থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তার কাছে তখন জীবন একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। একটা বোঝা নিয়ে জীবনযাপন তো পশুরই জীবন। এজন্য বিশ্বাসই মূলত জীবনের নোঙর। জীবনের নোঙর যদি না থাকে, তবে জীবনতরী উন্মত্ত সাগরে কোথা থেকে কোথায় হারিয়ে যাবে, কেউ জানে না।

পশ্চিমা দেশে এত আত্মহত্যার কারণ কী, জানেন? তাদের বিশ্বাসহীনতা। তাদের অঢেল অর্থ আছে, জীবন উপভোগ করার সব উপকরণ হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। পার্থিব জীবনের সকল কিছুই তাদের কাছে সস্তা। কিন্তু যখন তারা চিন্তায় উপনীত হয়—দিনশেষে এই জীবনের অর্থ কী? কেবলই ভোগ-উপভোগের পর টুপ করে মরে যাওয়া? তখন তারা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। যখন জীবনের কোনো অর্থই নেই, তাহলে এই জীবন রেখে লাভ কী?

এখানেই ইসলামের উৎকর্ষ। ইসলাম আমাদের এই জীবনের পর আরেক অলৌকিক জীবনের কথা বলে। সেই জীবনে বেহেশত-দোজখ আছে, অফুরন্ত সুখের আহ্বান বা নরক-আগুনের ভয় আছে। এবং সে জীবনটাকে সুখী করতে হলে একজন মানুষকে তার বর্তমান জীবনে বিশ্বাসের ভিত্তির উপর অটল থাকতে হবে, কখনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে বেখবর হওয়া যাবে না। একজন মানুষ প্রাত্যহিক ইবাদত-উপাসনা যদি না-ও করতে পারে তবু একক আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস কখনো হারানো যাবে না। কালেমায়ে তাওহিদের উপর তাকে পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহর একত্ববাদে অটল থাকতে হবে। এই বিশ্বাস ও পরকালীন জীবনের উপস্থিতি—এটা হচ্ছে একজন মানুষের মনে ইসলামের প্রথম কদম।

একজন মানুষের মনে যখন এই বিশ্বাস পোক্ত হবে—তুমি ও সৃষ্টিকর্তা একটি নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ, তখন মানুষ তার জীবনে বিশ্বাসের প্রথম ভিত্তি পায়। এই বিশ্বাস তার জীবনকে অর্থবহ করে তুলে। তাকে এমনি এমনি সৃষ্টি করা হয়নি আর সে-ও অযথা কোনো সৃষ্টি নয়। এই নশ্বর পৃথিবীতে তার উপস্থিতি নিখুঁত ও অর্থবহ এক পরিকল্পনার অংশ। জীবন অর্থবহ হলে এই নশ্বর পৃথিবীও তখন অর্থবহ। কেননা এই পৃথিবীর কর্মফল দিয়েই পরকালীন জীবনের এপ্রোচ ঠিক করা হবে।

ইসলামের এই বিশ্বাসের ভিত্তির শক্তি অপরিমেয়।

 

তৃতীয় কথা

এবার আসা যাক আমাদের বিশ্বাসের দ্বিতীয় পর্বে। আরাফাত সিয়াম তার পোস্টে অনন্তকাল (Eternity) বা অসীম মহাবিশ্বের (Eternal Universe) কথা বলেছেন, যেখানে তিনি তার রুহকে (আত্মা) পরিভ্রমণ করতে দেখেছেন। তার রুহ তার দেহ থেকে মুক্ত হয়ে অন্য এক ডাইমেনশনে চলে গিয়েছিল—এমন অনুভূতি হয়েছিল তার। আসলে এই অনুভূতির জন্য কোনো বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োজন গৌণ। এটা একটা প্র্যাকটিস, চিন্তার প্র্যাকটিস এবং এক ধরনের চৈন্তিক ভ্রম। আপনি যখন কোনো একটা বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন চিন্তা করতে থাকবেন এবং আপনার চিন্তা যদি আপনাকে ওই বিষয়ের প্রতি একনিষ্ঠভাবে পরিচালিত করে, আপনি তখন চোখ বন্ধ করলে সেই বিষয়ের নানামাত্রিক ছবি দেখতে পারবেন। এ বিষয়ে সাইকিয়াট্রিস্টদের নানা গবেষণা নিবন্ধ আছে এবং এটি থিউরিটিক্যালি হওয়া সম্ভব। পৃথিবীতে এমন বহুতর ঘটনা ঘটেছে।

এখানে বয়সও একটা ফ্যাক্ট। আরাফাতের বয়স সম্ভবত ২৫-এর বেশি হবে না। এই বয়সে এ ধরনের কসমিক চিন্তা ও আধ্যাত্মিক মেডিটেশন তার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলবে, এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।

এখানে পুরো বিষয়টিকে কেবলই আধ্যাত্মিক এপ্রোচ দেয়ার পক্ষপাতী আমি নই। তার আত্মহত্যার পেছনে শুধুই অনন্ত মুক্তির জন্য স্বেচ্ছামরণ গ্রহণ করা, ব্যাপারটা এত সরল নয়। এর পেছনে আরও বহু বিষয়, নানা অনুষঙ্গ অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক, তার ব্যক্তিগত জীবনাচার, জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা, কোনো অপরাধবোধ, তার পড়াশোনার চাপ, ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা ইত্যাদি আরও বহু বিষয় তার এই স্বেচ্ছামরণকে প্রভাবিত করতে পারে।

আমরা কি এই মহাবিশ্ব, এই সৃষ্টি ও স্রষ্টা, ঘুর্ণয়মান নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে ভাবি না? আমাদেরও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এক ক্ষুদ্র অণুর মতো বিচ্ছুরিত হয়ে মিলিয়ে যাই মহাশূন্যে। কই, আমরা তো মৃত্যুর কথা চিন্তা করি না। আমরা তো স্বেচ্ছামরণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না! কেন করি না? কারণ, আমাদের কাছে এই পৃথিবীর জীবনটারও একটা অর্থবহতা আছে। আমাদের জীবন এত নিরর্থ নয় যে এক রাতের মেডিটেশনেই সেটির অস্তিত্ব অনর্থক হয়ে যাবে। জীবনের ডালপালা চারদিকে এত অর্থ বহন করছে, এক রাতের মুহূর্তকালের অতিলৌকিক অনুভবে সেগুলো কীভাবে ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে?

একজন মানুষের জীবন কি একটি সুন্দর গিফট নয়? এই সুন্দর উপহারকে উপেক্ষা করার এখতিয়ার যদি মেডিটেশন বা ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়, তবে আমি এমন আধ্যাত্মবাদের বিপক্ষে। এমন চিন্তা ও প্র্যাকটিস অবশ্যই নিন্দনীয়। জীবন পরিভ্রমণ ব্যতীত কেউ কেবলই আত্মার অনুসারী হলে খোদা তাআলার তো তবে দেহ-মন সর্বস্ব মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজনই ছিল না।

 

চতুর্থ কথা

আমি বলছি না আরাফাত সিয়ামের সঙ্গে এমনটিই ঘটেছে। পুরো পরিভ্রমণটাই একধরনের হ্যালুসিনেশন বা মনোভ্রম ছিল, এমনটি দাবি করা শতভাগ সঠিক হবে না। হতে পারে সত্যিকারার্থেই তার আত্মা তাকে ভিন্ন কোনো ডাইমেনশনে নিয়ে গিয়েছিল। এবং আমাদের ইসলাম ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সেটা সম্ভবও। আমাদের নবীজির ‘মেরাজ’ এমন ভিন্ন ডাইমেনশনেই হয়েছিল। কেননা পৃথিবীর ডাইমেনশন বা মাত্রা অনুযায়ী মাত্র কিছু মুহূর্তের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুজালেম, সেখান থেকে মহাকাশ-সপ্তাকাশমণ্ডলী পাড়ি দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত, বেহেশত-দোজখ পরিভ্রমণ শেষে আবার ফিরে আসা, এসব কিছু পৃথিবী ও মানুষের শারীরিক সক্ষমতার ডাইমেনশনে করা সম্ভব নয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মানুষের আত্মা কিন্তু ডাইমেনশনের থিউরি অনুযায়ী চলে না। আত্মা এক অসীম শক্তির আধার এবং কী পরিমাণ শক্তি সে ধারণ করে, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। আল্লাহ তাআলা সুরা বনি ইসরাইলে নবীজিকে সম্বোধন করে বলছেন, ‘লোকজন আপনাকে রুহের (আত্মা) ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, তাদের বলে দিন, রুহের বিষয় পুরোটাই আল্লাহর কব্জায়, এ বিষয়ে তোমাদের স্বল্প পরিমাণ জ্ঞান দেয়া হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮৫)

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, নবীজির মেরাজ গমনের ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে সুরা বনি ইসরাইলেই। সুতরাং আত্মার অসীম সক্ষমতা এবং পৃথিবীর ডাইমেনশনের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে মেরাজের যে যোগসূত্র রয়েছে, এটি জোর দিয়ে বলা যায়।

তাছাড়া আমরা বিভিন্ন বুজুর্গ ব্যক্তি বা পীর-দরবেশদের ব্যাপারে শুনে থাকি, তারাও ধ্যান বা মোরাকাবার মাধ্যমে তাদের শরীর থেকে রুহকে ভিন্ন ডাইমেনশনে নিয়ে যেতে পারেন এবং তাদের রুহ তাদের শরীর থেকে মুক্ত হয়ে মুহূর্তেই পৃথিবী বা ঊর্ধ্বলোকের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই রুহের এই পরিভ্রমণে পৃথিবীর যে ত্রিমাত্রিক ডাইমেনশন, সেটা কাজ করে না। কেননা রুহ বা আত্মার জন্য ডাইমেনশন কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়।

সুতরাং ধ্যান, মোরাকাবা, মেডিটেশনের মাধ্যমে রুহকে জাগতিক ডাইমেনশনের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব; নবীজির মেরাজ ও ইসলামের আধ্যাত্মবাদ এটাকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস থেকে আরও বহু সূত্র ও ঘটনা উল্লেখ করা সম্ভব।

 

পঞ্চম কথা

আরাফাত সিয়াম তার পোস্টে যে পরিভ্রমণের কথা বলেছেন, এই পরিভ্রমণ আমার কাছে খুব বেশি অর্থ বহন করে না। আমার কাছে অর্থ বহন করে তার অনুসন্ধিৎসা ও গাইডলেস জার্নি এবং তার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তো অবশ্যই।

তার মৃত্যুর কথা চিন্তা করি। তিনি হঠাৎ একদিন মেডিটেশন করতে করতে উপলব্ধি করলেন, তিনি এক অমৃতের সন্ধান পেয়ে গেছেন এবং অমৃতের চির স্বাদ আস্বাদন করতে হলে তাকে শরীরের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অবিনশ্বরের দিকে যাত্রা করতে হবে। সুতরাং মৃত্যুই একমাত্র পথ। কিন্তু এটা যে একটা ভুল চিন্তা, এই কথাটা তাকে বলার মতো কেউ ছিল না।

চিন্তাটা ভুল কীভাবে?

ধরুন, আপনি জীবনে প্রথমবার যৌনসঙ্গম করলেন। কাজটি করার পর আপনার ভেতরে প্রবল ভালোলাগা সৃষ্টি হলো। এখন এই ভালোলাগার স্মৃতি যাতে চিরদিন অটুট থাকে, এ জন্য কি আপনি আপনার গোপনাঙ্গ নষ্ট করে ফেলবেন?

আপনি একটি ফুলের সুবাস নিলেন। ফুলের সুবাস মৃত্যু পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখতে এখন আপনি কি আপনার ঘ্রাণেন্দ্রীয় নষ্ট করে ফেলবেন?

তেমনি একদিন হঠাৎ মেডিটেশন বা ধ্যান করতে করতে আপনি ডাইমেনশনলেস এক অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান পেয়ে গেলেন। তারপর আপনার মনে হলো, এরপর আমার আর কিছু পাওয়ার নেই। কাজেই অনন্ত সৃষ্টিতে হারিয়ে যেতে হলে আমাকে স্বেচ্ছামরণ বেছে নিতে হবে। এটা একটা বোকামী হয়ে গেল না? তাহলে আপনাকে জন্মদানের কী প্রয়োজন ছিল? পৃথিবীতে আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কী? মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে আপনার উপস্থিতির রহস্য তবে তো অধরাই রয়ে গেল। এটা তো জড়বাদপূজারীর মতো হয়ে গেল। আপনার চিন্তা, আপনার বিশ্বাস, মহাকালে আপনার উপস্থিতির তবে মূল্য কী রইল? এই যে মানবপ্রজাতির উদ্ভব, এই উদ্ভবের প্রয়োজন তবে কী ছিল? হঠাৎ করে একদিন স্বপ্নে অলীক মহাবিশ্ব দেখে পরদিন ফুড়ুত করে মরে যাওয়াই কি মানবপ্রজাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য?

আপনার তো উচিত প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে এই অনুভূতির স্বাদ আস্বাদন করা যে আমি মহাবিশ্ব সৃষ্টির নিগুঢ় সূত্র জেনে ফেলেছি। আপনার তো ফার্মগেটের তীব্র ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হেসে উঠা উচিত যখন আপনি জানতে পারবেন, সৃষ্টিকর্তা কেন মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর সবাই যা জানে, আপনি ভিন্ন এক উচ্চতায় গিয়ে নতুন এক সত্য জানতে পেরেছেন। আপনার তো উচিত এই জ্ঞান, এই প্রজ্ঞা, এই অনুপম সৃষ্টি, জাগতিক দৃষ্টির ভেতর দিয়ে দেখা অন্য আরেক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে দেখা। আপনি প্রতি মুহূর্তে এই বিস্ময় দেখবেন আর আনন্দ লাভ করবেন। এটাই তো মানবজন্মের স্বার্থকতা। একদিন আপনি এক সত্য উদ্ঘাটন করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার মশাই আমাকে মরে যেতে হবে। এটা তো মানবজন্মের জলজ্যান্ত পরাজয়।

 

ষষ্ঠ কথা

একজন সাধারণ মানুষের চিন্তার চেয়ে আধ্যাত্মবাদ খানিকটা উপরের তবকার জিনিস। সবাই হয়তো এই চিন্তার টার্ম ও পদ্ধতিগুলো বুঝতে পারবে না। কিন্তু যারা এই চিন্তা ও তরিকার নাগাল পেয়েছেন, তাদের জন্য একজন গাইড বা একজন রাহবার আবশ্যিক। জালালুদ্দিন রুমির জন্য যেমন শামছুত তাবরেজি, ইবনে আরাবির ছিলেন ইউসুফ আল-কুমি, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জন্য বাবা ফরিদ, লালন সাঁইয়ের যেমন সিরাজ সাঁই। প্রত্যেক আধ্যাত্মিক চিন্তা ও এ পথে জার্নির জন্য সমচিন্তার একজন পথপ্রদর্শক অতীব জরুরি।

আরাফাত সিয়াম শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তার নানামাত্রিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং নিজের মতো করে সেই জ্ঞান যাচাই করেছিলেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক চিন্তার বিষয় শুধু জ্ঞান ও বইপাঠের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয় না। এটা একটা দীর্ঘ প্র্যাকটিসের বিষয়। সেই প্র্যাকটিসের বহুমুখী ধারা রয়েছে। একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি যখন কোনো দরবেশ বা পীরের কাছে যান, ওই পীর তখন ওই ব্যক্তির ‘হালত’ অনুযায়ী তার ‘এলাজ’ করেন। একজন আরাফাত সিয়াম আর একজন রিকশাওয়ালা মুরিদকে একজন পীর একই ‘এলাজ’ দেবেন না। পীর বা সুফিগণ প্রত্যেকজন মুরিদকে দেখে ও কথা বলে বুঝতে পারেন কার ‘হালত’ কেমন। তাকে সেই পরিমাণের ওজিফা ও দাওয়াই দেয়া হয়।

‘ওজিফা’ হলো একজন মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তা ও জার্নিকে কন্ট্রোল করার লাগাম। ওজিফা নামের এই লাগামকে শুধু জিকির আজকার মনে করলে আপনি ভুল করবেন। আপনার চিন্তা যেমন কেবলই হৃদয় ও আত্মার অন্তর্গত বিষয়, তেমনি আপনার অন্তর্গত চিকিৎসাও ভেতরে ভেতরে হবে। আপনার চিন্তার জন্য আপনাকে বড় বড় বই-পুস্তক বা রাশি রাশি জ্ঞান দেয়া হবে না। বরং আপনার চিন্তা যাতে সঠিক পথে পরিচালিত হয় এ জন্য আপনাকে ভেতরগত দাওয়াই দেয়া হবে, যাতে আপনি আপনার চিন্তার বাগডোর নিজেই কন্ট্রোল করতে পারেন।

আমাদের ইসলাম ধর্মে সুফিবাদের তরিকায় এ জন্য ‘হাত ধরা’র বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়।

 

সপ্তম কথা

এই ঘটনাকে কিছু ধার্মিক মানুষ, কিছু আলেম-তলাবা বা কিছু সাধারণ মানুষ হয়তো তাচ্ছিল্য করবেন। কিন্তু এ ঘটনাটি তাচ্ছিল্য করার মতো নয়। পৃথিবী যত উন্নত হচ্ছে, আমরা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারে বিস্মিত হচ্ছি। মানুষ জ্ঞান অর্জনের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার সাহস পাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ কখনো অস্থির হয়ে উঠছে। ফলে মানুষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান নিয়ে আরও বেশি কিউরিয়াস হচ্ছে। তারা জানছে এবং আরও জানার চেষ্টা করছে। জ্ঞানের পথে মানুষের সফরকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্য করবেন না। আপনি আমি তার জ্ঞানের উত্তর দিতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া প্রয়োজন।

আধ্যাত্ম জ্ঞানের এই সফরে তাদের যদি পথপ্রদর্শন না করা হয় তবে আরাফাত সিয়ামের মতো আরও বহু তরুণ অকালে ঝরে যাবে নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া এ ধরনের জ্ঞান ও চিন্তার চর্চা করা তো অপরাধ নয়। বরং এ চিন্তা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। আমরা ইসলামের যেসব সুফিদের কথা জানি ও পড়ি, তারা প্রত্যেকেই আধ্যাত্ম সফরের এই পথ পাড়ি দিয়েছেন।

ইসলামের ইতিহাসে আবদুল কাদের জিলানি, মনসুর হাল্লাজ, জালালুদ্দিন রুমি, ইবনে আরাবি, ফখরুদ্দিন রাজি, মুঈনুদ্দীন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়াসহ আরও হাজার হাজার সুফি-দরবেশ—এরা সবাই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। তারাও কথা বলতেন অনন্তের, ঊর্ধ্বলোক ও এক অজান্তা অনুভূতির। তারা নিজেদের অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়াতেন অসাধ্য সব স্থান-কালে। পার্থিব এক ডাইমেনশ থেকে তারা উন্নীত হতেন ঊর্ধ্বলোকের আরেক ডাইমেনশনে। তারা এসব অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। আল্লাহর বড়ত্ব, তার অসীমতা, তার ক্ষমতার মহালৌকিকতা তাদের ভেতরে সৃষ্টি করত বিনয়। তারা আল্লাহর বিশালত্বের সামনে নিজেদের ‘আমিত্ব’কে লীন করে দিতেন। আমি কে? আমি কিছুই না।

এটাই ইসলামি সুফিবাদরে মর্মকথা। নিজেকে জানো। তোমার ক্ষমতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হও। রুমি যখন বলেন, ‘তুমি সাগরের মধ্যে এক বিন্দু জল নও, বরং তুমি এক বিন্দু জলের মধ্যে অতলান্ত এক সাগর।’

এই কথার নিগুঢ়তা ভয়াবহ। আরাফাত সিয়াম যদি এই কথার নিগুঢ়তা বুঝতেন তাহলে হয়তো নিজের স্বেচ্ছামরণ বেছে নিতেন না। তুমি এই ঘিঞ্জি পৃথিবীর সীমাবদ্ধ ডাইমেনশন থেকে উত্তরিত হয়ে প্রবেশ করতে পারছো এক অনন্ত অসীম ডাইমেনশনে, এর চেয়ে সুখের, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? তুমি এই আনন্দ সৃষ্টির মাঝে ছড়িয়ে দাও। দেখো একটা ফুল কী গৌরব নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়। কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটায় মাটির বুক থেকে উদ্গত হয় উদ্ভিদের জীবন, কীভাবে একটা শিশু মায়ের বুকে নিরুপদ্রবে ঘুমিয়ে থাকে নিরাপদে, এসবই তো তোমার মানবজন্মের আধ্যাত্মিকতার প্রতিফল। মৃত্যু তো তোমাকে অনন্তের স্বাদ দেবে না। তুমি যদি সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকে অসীমতার স্বাদ আস্বাদন করতে না পারো, তবে তোমার অনন্ত যাত্রার সার্থকতা কোথায়? তুমি এখন যে অনন্ত শূন্যতার ভেতরে নিজেকে সমর্পণ করলে, সেখানে সকল কিছুই অসীম, অনন্ত। অনন্তের ভেতরে গিয়ে তুমি অনন্তের কী স্বাদ লাভ করবে? তোমাকে সীমাবদ্ধ ডাইমেনশন থেকে উড্ডীন হতে হবে অনন্ত ডাইমেনশনের দিকে। এই মূর্তমান ধুলির ধরার সীমাবদ্ধতা থেকে যখন তুমি প্রতি মেডিটেশনে ছুঁয়ে আসবে অসীম ডাইমেনশন, সেই মুহূর্তগুলোই জীবন। এই জীবনের জন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব।

তোমাকে আমি জীবনের এই পাঠ দিতে পারিনি বলে আমি লজ্জিত। আমি অপরাধবোধে জর্জরিত। আমাকে ক্ষমা করো।

 

পরিশিষ্ট

আমি বাংলাদেশের প্রয়াত এক আলেমের ব্যাপারে শুনেছি। বাংলাদেশের বড় এক মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন তিনি। শতবর্ষী বুজুর্গ ব্যক্তি। মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগে। জীবদ্দশায় তিনি কোন পীরের মুরিদ, কোন সুলুক এখতিয়ার করেন, কী অজিফা পাঠ করেন, আধ্যাত্মিকতার কোন তবকায় বিচরণ করেন—এসব নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না। তিনি কাউকে সেভাবে মুরিদ-খেলাফতিও দিতেন না। নিজ জেলা এবং বাংলাদেশের মানুষ তাকে একজন শতবর্ষী বুজুর্গ আলেম বলেই চিনতো। তার আধ্যাত্মিকতার আলোচনা কখনো সেভাবে চাউর হয়নি।

তার মৃত্যুর পর তার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছে শুনতে পাই, এই বুজুর্গব্যক্তির একজন আধ্যাত্মিক বন্ধু ছিল, নিতান্ত এক গ্রাম্য মাদরাসার শিক্ষক। তিনিও বৃদ্ধ। তারা দুজন রাতেরবেলা কখনো কখনো লোকালয় থেকে দূরে নির্জন কোনো স্থানে গিয়ে জিকির করতেন, আল্লাহর ধ্যানে লীন হতেন, সুফিতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে মুজাকারা করতেন। লিল্লাহিয়্যাত, ফানাফিল্লাহ, আনালহক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সৃষ্টি, আকাশের ওপারে আকাশ—এসব নিয়ে কথা বলতেন। তবে লোকসম্মুখে তারা কখনো তাদের এই একান্ত বিষয়াদি আলাপ করতেন না। এ ছিল তাদের একান্ত উপলব্ধির বিষয়, তাদের নিজস্ব অনন্ত যাত্রার অভিজ্ঞতা।

আধ্যাত্মিকতার জন্য রাহবার বা গাইড জরুরি। প্রতিটি চিন্তার জন্য, প্রতিটি অনুভূতির জন্য কারো পথপ্রদর্শন জরুরি। এজন্যই বলা হয় ‘সিনা-ব-সিনা’ হৃদয় থেকে হৃদয়ে স্থানান্তরিত হয় আধ্যাত্ম দর্শন। নিজে নিজে সবজান্তা হয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে স্বেচ্ছামরণের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা নিশ্চয় কোনো আধ্যাত্মিক দর্শনে পড়ে না।

 

মাসিক নবধ্বনির সৌজন্যে


Leave a Reply

Your email address will not be published.