মসজিদে নববির চত্বরে যখন বসি, মনে হয়, এই চত্বরে নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঙ্গে হেঁটে বেড়িয়েছেন আয়েশা। উত্তরের উহুদ পাহাড়শ্রেণি থেকে উড়ে আসা উষ্ণ দমকা হাওয়ায় উড়ত আয়েশার চুল। নবীজির সঙ্গে কখনো কখনো হাঁটতে যেতেন জান্নাতুল বাকি বা আরও দূরে। দূরের পাহাড়গুলো কি এখনও নবীজির স্মৃতি মনে রেখেছে? রুক্ষ পাথর কি ধরে রেখেছে আয়েশা কিংবা উম্মুল মুমিনিনদের পবিত্র পদরেখা? এই নববি চত্বরেই ছিল তাদের ছোট ছোট ঘরদোর। একটু দূরে ছিল ফাতেমার জীর্ণ কুটির। ফাতেমা প্রায়ই দেখা করতে আসতেন বাবার সঙ্গে। ও পাড়ায় থাকতেন আবু বকর। ইবনে কুহাফা ঘরে আর কী থাকতেন, নবীজির ছায়াসঙ্গী হয়ে মসজিদে নববিতেই পড়ে থাকতেন হামেশা।

আবু আইয়ুব আনসারিকে কোথাও দেখি না। দেখি না সাদ ইবনে মুআজকে। আসাদ ইবনে জুরারার কথা মনে পড়ে। মদিনার সেই ছয় যুবকের একজন ছিলেন তিনি, সর্বপ্রথম মক্কায় যাদের সঙ্গে মদিনায় হিজরতের ব্যাপারে মতবিনিময় করেছিলেন নবীজি। নবীজিকে মক্কা থেকে মদিনায় নিয়ে আসার ব্যাপারে সবচেয়ে উদ্যোগী ছিলেন এই যুবক।

নবীজি যখন মদিনায় হিজরত করে এসে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন, সবার আগে এগিয়ে এলেন আসাদ। নাজ্জার গোত্রের পরিত্যক্ত কবরস্তানের পাশে নবীজি যে জায়গাটি পছন্দ করলেন মসজিদে ননবি নির্মাণের জন্য, জায়গাটি ছিল আসাদের দুই এতিম ভাতিজার। তিনি জায়গাটির জন্য কোনো দাম নিতে চাইলেন না। নবীজি মসজিদ নির্মাণ করবেন, তিনি কীভাবে সেটির দাম নেবেন? কিন্তু নবীজি দশটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে দুই এতিমের কাছ থেকে কিনে নিলেন জায়গাটি। শুরু হলো মসজিদে নববি নির্মাণ।

আসাদ ইবনে জুরারার দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য, জানি না, নবীজি মদিনায় হিজরতের মাত্র ছয় মাস পর তরুণপ্রাণ এই যুবক মৃত্যুবরণ করেন। সুস্থ মানুষ, নবীজি এবং আর সব সাহাবির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মসজিদে নববি নির্মাণের কাজ করছিলেন। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। নবীজি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আসাদের আকস্মিক মৃত্যুতে। হিজরতের পর মদিনার মূলভূমিতে প্রথম মৃত্যু। নবীজি ব্যথাভরা হৃদয়ে তাঁর জানাজা পড়ালেন। নিজ হাতে যুবক বন্ধুকে শুইয়ে দিলেন কবর অন্ধকারে। নবীজির চোখভরা কান্না।

আসাদ ইবনে জুরারা, দেখো! তোমার হাত দিয়ে ভিত্তি পাওয়া মসজিদে নববি চত্বর আজ লাখো মানুষের গুনগুনিয়ে গাওয়া দরুদে থই থই করছে। যে নবীজিকে ভালোবেসে তুমি তাকে মক্কা থেকে মদিনায় নিয়ে এসেছিলে, দেখো, আজ মানুষের স্রোত প্রতি বেলা ভালোবাসার অশ্রু দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে সেই নবীর মসজিদ। কত মানুষ নামাজ পড়ছে, হাঁটছে, শিশুরা খেলা করছে, কত মানুষ ঘুমিয়ে আছে শান্ত চত্বরে। যেমন তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে অবেলায়।

আসাদ, তুমি যদি আরও কিছুদিন জীবিত থাকতে, দেখতে, তোমার নাজ্জার গোত্রের যুবকেরা বদরে-হুনাইনে কীভাবে লড়াই করছে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো। উহুদের রক্তরাঙা দিনেও তারা বুকের তাজা খুন ঢেলে রক্ষা করেছে তোমার নবীজির জীবন। তোমার ভালোবাসা বৃথা যায়নি।

যদি তোমার জীবন আরেকটু সময় দিত তোমাকে, দেখতে, তোমার গোত্রের চঞ্চল কিশোর আনাস ইবনে মালিক একদিন মসজিদে নববির বারান্দায় শত শত হাদিস শিক্ষার্থীর সামনে বসে বর্ণনা করছেন নবীজির জীবন। দেখতে, সেই ছোট্ট জায়িদ ইবনে সাবিত ইসলামের প্রথম বিচারপতি হয়ে প্রতিষ্ঠা করছেন ন্যায় ও ইনসাফের শাসন। দেখতে, তোমার গোত্রের বীরপুরুষ আবু আইয়ুব আনসারি মিশর-সিরিয়া জয় করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন তুর্কিস্তানের কোনো অজ্ঞাত স্থানে। জীবনের অন্তিম অসিয়তে তিনি তাঁর সেনাপতি ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়াকে বলছেন, ‘আমি মারা গেলে যতটা সম্ভব কাফের-ভূমির সন্নিকটে আমার কবর দেবে। যাতে পরবর্তী কোনো মুসলিম সেনাদল যখন কন্সটান্টিনোপল জয় করতে আসবে, তাদের ঘোড়া যেন আমার কবর মাড়িয়ে এগিয়ে যায়। আমি কবর থেকেও তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে চাই।’

আসাদ, তোমার উদ্যোগ বৃথা যায়নি। আজ তুর্কিস্তানের লাখ লাখ মসজিদে প্রতিদিন পাঁচবেলা ধ্বনিত হয় কালেমার আজান। রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

দুই

প্রাচীন মদিনার সব স্মৃতিচিহ্ন ধুলোয় মিশে তার উপরে গড়ে উঠেছে মসজিদে নববি, বিরাট চত্বর। পূর্ব মদিনায় আবদুল আশহাল, বনু নাজ্জার, আবদে কায়েস গোত্রের মহল্লায় এখন বিশাল বিশাল ফাইভ স্টার হোটেল। নবীজির মদিনার কিছুই অবশিষ্ট পাওয়া যাবে না এখন। অবশ্য চৌদ্দ শ বছর আগের স্মৃতিভূমি সংরক্ষণ আর সম্ভবই বা কীভাবে হবে। কালের বিনাশী বিবর্তনে হারিয়ে যায় সকল কাঠামো। সকল স্মতিচিহ্ন।

আমি তবু চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাই মক্বা থেকে মদিনায় হিজরতের চলচ্চিত্র। কোবা পল্লির মসজিদ থেকে সকালে রওনা হয়ে নবীজি জুমআর নামাজ পড়লেন সালিম গোত্রের মহল্লায়। এটা ছিল নবীজির প্রথম জুমআ। জুমআ শেষ করে তিনি এগিয়ে এলেন মদিনার দিকে, দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করলেন প্রাচীন ইয়াসরিব পল্লিতে। তার আগে আগে তাকে প্রটোকল দিয়ে নিয়ে আসছিল নাজ্জার গোত্রের যুবকেরা। ওরা ওয়াদাবদ্ধ, নবীজির নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী হবে।

মদিনার একটি দোতলা বাড়ির ছাদে আমি যেন দেখতে পাই মদিনার কিশোর আনাস ইবনে মালিককে, যিনি হিজরত দিনের হাদিস বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

নবীজি এলেন। মদিনার শিশু-কিশোররা গেয়ে উঠল:

তালাআল বাদরু আলাইনা

মিন সানিয়্যাতিল বিদা

ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা

মা দাআ লিল্লাহি দাআ