সম্ভবত ২০১৪ সালে একবার আমার ঠাকুরগাঁও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশৈংকলে দুদিন ছিলাম। দুদিন অবস্থানকালে জানার চেষ্টা করেছিলাম— আশেপাশে কোনো কওমি মাদরাসা আছে কি-না। খবর নিয়ে জানলাম— রাণীশৈংকলে কোনো কওমি মাদরাসা নেই। থাকার মধ্যে দু-একটা মক্তব আছে কেবল। আচ্ছা! তো, ঠাকুরগাঁও জেলায় বড় কোনো মাদরাসা নেই? না, পুরো ঠাকুরগাঁও জেলায় বড় কোনো মাদরাসা নেই। দু-চারটে মধ্যম সারির মাদরাসা আছে বটে, তবে অধিকাংশই আলিয়া মাদরাসা। এর প্রমাণ পেলাম স্থানীয় এক মসজিদে জুমআর নামাজ পড়তে গিয়ে। খতিব সাহেবের দাড়ি স্টিম রোলার, জামা চারশো টাকার ফুলতোলা সবুজ পাঞ্জাবি। জেলার অধিকাংশ মসজিদের ইমাম সাহেবই তথৈবচ। আর খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরের প্রবল প্রতাপ না হয় এখানে অনুল্লেখই থাক।

কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জের জামিয়া রব্বানিয়া মাদরাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে আল-আমিন নামে লালমনিরহাটের এক মাদরাসাছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো। কথায় কথায় জানতে পারলাম— তাদের লালমনিরহাটে দাওরাসম্পন্ন কোনো মাদরাসা নেই। শুনে আরও আশ্চর্য হলাম— ছয়টি জেলা নিয়ে গঠিত পুরো রংপুর বিভাগে দাওরাসম্পন্ন মাদরাসা মাত্র তিনটি। দুটো রংপুরে, আরেকটা সৈয়দপুরে। (খবর নিয়ে যা জানতে পারলাম)

দুই
এবার আসল কথা বলি। উত্তরবঙ্গের এসব জেলার প্রচুর ছাত্র হাটহাজারীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাদরাসায় পড়াশোনা করে থাকে। ঢাকা বা বগুড়া-সিরাজগঞ্জের অনেক মাদরাসায়ও বহু ছাত্র পড়াশোনা করেছে এবং বর্তমানেও করছে। মাদরাসা থেকে উচ্চতর শিক্ষা সমাপ্তকারী উত্তরবঙ্গের অনেক আলেম পাওয়া যাবে যারা সারা বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও মাদরাসায় পড়াচ্ছেন বা মসজিদে ইমাম-খতিবের চাকরি করছেন। এই সংখ্যা বিশাল।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ধর্মীয় উচ্চ জ্ঞানসম্পন্ন এই বিশাল আলেমগোষ্ঠী নিজ এলাকায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় তেমন একটা উদ্যোগী নন। তারা বড় বড় মাদরাসা থেকে জাদরেল জবরদস্ত ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোনো মাদরাসায় শিক্ষকতাকেই নিজের জীবনের ফরজিয়াত সাব্যস্ত করে রাখেন। তার এলাকার মানুষ খ্রিষ্টান হচ্ছে, ধর্মহীন হয়ে জীবনযাপন করছে, ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিতে জনপদ জাহেলিয়্যাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে অনেক আলেমই বেখবর। অথচ আলেমের কাজই হচ্ছে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথ দেখানো।

ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের জন্য বাংলাদেশে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা যদি ফরজ হয়ে থাকে, তবে বর্তমানে সে হুকুম কেবল উত্তরবঙ্গের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা যদিও ফরজে কেফায়া, কিন্তু উত্তরবঙ্গের জন্য এ মাসয়ালা ফরজে আইন। সুতরাং রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও এবং এতদসংলগ্ন এলাকার যেসব মাওলানা সাহেবরা নিজ এলাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় ‘খেদমতে’ লিপ্ত, তারা প্রতিমুহূর্তে একটি ফরজ লঙ্ঘন করার পাপের ভাগীদার হচ্ছেন। আল-কুরআনে আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন— 
‘…সুতরাং তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হয় না কেন, যাতে অবশিষ্ট লোক ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং যাতে তারা নিজ সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলে তাদেরকে সতর্ক করতে পারে। যাতে তারা সাবধান হতে পারে।’ (সুরা তওবা, আয়াত ১২২)

তিন
আমার একান্ত অনুরোধ— 
উত্তরবঙ্গের যেসব আলেম দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকতা করছেন, তারা এবার নিজের মাটির কাছে ফিরে আসুন। বড় মাদরাসা, বড় পদ আর মোটা টাকা উপার্জনের আকর্ষণ মাড়িয়ে ফিরে আসুন আপনার প্রাণের স্পন্দনের কাছে। উত্তরবঙ্গের প্রতিটি গ্রাম-জনপদ আপনাদের ডাকছে। আপনার পরিচিত ফসলের খেত, পথ, নদী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

নিজ এলাকায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু করুন। যতোটুকু সম্ভব, সেভাবেই শুরু করুন। মক্তব দিয়ে শুরু করুন, একদিন জামিয়া হবেই। নিয়ত খালেস রাখুন, বুকে সাহস বাঁধুন, লক্ষ্য রাখুন দৃঢ়; কোনো বাধাই দমাতে পারবে না। পুরো উত্তরবঙ্গজুড়ে প্রচুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, উত্তরবঙ্গের সকল আলেমের ওপর এটা ফরজে আইন। আপনারা শুরু করুন, একদিন এ উত্তরবঙ্গই হবে বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার সবচে শক্তিশালী দুর্গ-জনপদ।

আজ থেকে দশ বছর পর উত্তরবঙ্গে অন্তত দশটা দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) মানসম্পন্ন মাদরাসা দেখতে চাই।

রাজধানী কিংবা বড় শহরের চাকচিক্য পেছনে ফেলে চলে আসুন এই দারিদ্রপীড়িত মানুষের দহলিজে। চিন্তা করবেন না, এই দরিদ্রদের মাঝ থেকেই একদিন জন্ম নিয়েছিলো— আবু হুরায়রা, ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, কাব, মুসআব, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মতো প্রাজ্ঞজন। যাদের প্রজ্ঞার আলোয় আজও আলোকিত হয়ে আছে সমগ্র কায়েনাত।

মনে রাখবেন, সপ্তম শতকে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম আগমন করেছিলো এই উত্তরবঙ্গে। এ অঞ্চলেই শুয়ে আছেন শত সহস্র মুবাল্লিগে ইসলাম, যারা নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে এ অঞ্চলকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে এসেছিলেন। এই উত্তরবঙ্গ থেকেই সারা বঙ্গভূমিতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। অথচ কী দুঃখের কথা, আজ সে জনপদ ধর্মহীনতার মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে অথচ সেখানকার মুবাল্লিগরা জনপদের ব্যাপারে বেখবর। তারা নিজেদের জনপদকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাওলা করে নিজেরা হিজরত করে চলে গেছেন নিশ্চিত উপার্জনের উচ্চাশায়।
ফিরে আসুন এই বরকতময় ও স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমিতে।

বারো বছরব্যাপি কওমি মাদরাসার শিক্ষা এবং দীক্ষা আপনাকে ইসলাম প্রচার-প্রসারের সবক শিখিয়েছে, বড় মাদরাসায় শিক্ষকতা করার উচ্চাভিলাষ শেখায়নি।