১.০
যে বিরাট দিয়েছো প্রেম
হাবিয়া দোজখ—কিছু নয়, কিছু নয়

কবিতার ক্যানভাসে শীর্ণ দুটি পঙক্তি—কবির করতলে এ-ই যেন সব। আর নেই। পূর্ণ কলেবর। তো ভাব ও আবহ কী বিশাল! প্রেম—মৃত্যুকে, জীবনের আবিলতাকে, হাবিয়া দোজখের অগ্নিশিখাকেও জয় করে ফেলে। প্রেম দিয়েই পরম পালিয়তাকে আপন করে নেন আশিক-কবি। তিনি নির্ভার ও ভয়শূন্য হন। জান্নাত-জাহান্নাম তার কাঙ্ক্ষিত নয়। তাসাউফের এই বিনীত উচ্চারণের পাশে এসেছে আরও বিবিধ অনুষঙ্গ।…

১.১
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কবিতার বই ঈশ্বর আসেন কথাবার্তা বলি। ৬৪টি রূপালি পৃষ্ঠায় মলাটবদ্ধ হয়েছে ৩৪টি কবিতা। অসংখ্য টুকরো টুকরো ভাবের সমারোহ, যূথবদ্ধ নিটোল আয়োজন। বইটির নামকরণে এসেছে সিকুইলার শব্দ ‘ঈশ্বর’। এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার নাম। যদিও উৎসর্গপত্রে ‘আল্লাহ’ শব্দটি স্বমহিমায় উৎকীর্ণ।

১.২
বাংলা কবিতার ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি। চর্যাপদে রয়েছে বৌদ্ধ সহজিয়াদের গভীর তত্ত্বকথা। মধ্যযুগের ছয়শ বছরে আমারা পেয়েছি কাহিনীকাব্য, বৈষ্ণবকবিতা, মঙ্গলকাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, দোভাষী পুঁথি আরও কত কী। এরপর আধুনিক যুগ কবিতার কোলাহলে আবৃত। এসেছে নারী-পুরুষের প্রেম, নিসর্গভাবনা, স্বদেশপ্রেম। কিন্তু এ-সব কিছুর যিনি সৃজয়তা তার কথা একেবারেই দুর্লভ। দু-একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বাদে প্রভুপ্রেমের বিষয়ে অন্যান্য কবিকণ্ঠ নীরব। অথচ সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কাব্যে মহান রবের কথা, প্রিয় রাসুল (স.) ও সঙ্গীদের কথা বারবার এসেছে। মুমিনের পৃথিবীবাস, মৃত্যু, বরজখ জীবন, পরকালের অনিঃশেষ জীবনপ্রবাহ—আরও কত কিছু।…

১.৩
আমরা জানি, যেকোনো মহৎ সৃষ্টির পিছনে একটি আশ্বাসের বার্তা থাকে এবং একটি তত্ত্বদর্শন লুকিয়ে থাকে। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কবিতার বাইরের আবরণ স্বচ্ছ কাচের মতো যেন কিশোরীর সরল হাসিতে প্লাবিত, তবে ভেতরের গভীরতা এত তীক্ষ্ণ ও প্রতনু যে, যে বোঝে না তাকে বুঝিয়ে দেওয়া মুশকিল। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের সত্য যেন কল্পনার হলুদ পাখায় ভর করে আজকের বাস্তবতার সাথে মিশে একাকার হয়। নির্মিত হয় শিল্পসত্য। কবির ব্যক্তি সংবৃত্তিকে এখনকার পাঠক সহজেই নিজের করে নিতে পারেন :
আমি উহুদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা
যখন মুসআব কনুইকাটা হাত দিয়ে
বুকের ওপর ধরে রেখেছিলেন রক্তাক্ত আমার নিশান
আর মুখে উচ্চারণ করছিলেন—
ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসুল…
(ইজখির ঘাস)

চিহ্নিত শব্দগুলো (উহুদ, ভূলুণ্ঠিত পতাকা, কনুইকাটা হাত, রক্তাক্ত আমার নিশান, ওয়ামা মুহাম্মাদুন…) দেখুন। ইসলামের ইতিহাসের একমুঠো বিবর্ণ ছবি, তাপিত অনুভব, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেয়। নস্টালজিক হয়ে ওঠে আমার মতো নির্মোহ পাঠকের মন। তখন এলিয়টের ঐতিহ্য—অণু, বোদলেয়ারের প্রেম-সংরাগ, কালিদাসের যক্ষ্ম-মালবিকার বিরহ-উচ্ছ্বাস, ইকবালের ‘আসরারে খুদি’র বিমূর্ত ভাবনার দৃশ্য দেখি। কী দীপ্র স্মৃতির আতরমাখা এসব শব্দ!

১.৪
‘হাজার বছরের ভালোবাসা’, ‘আমি তোমার ক্রীতদাস’, ‘কাবার ডাক’ কবিতায় ব্যক্তি-অনুভবের সাথে মিশেছে ইতিহাসের উপাদান। যেকোনো ইতিহাসের সত্যই রুক্ষ, কঠিন। তার ব্যক্তি-অনুভবের স্পর্শে বিষয় স্নিগ্ধ ও কমনীয় হয়ে উঠেছে।
আমার ঘরে আপনাকে স্বাগতম
হে সৃষ্টির প্রথম অবয়ব, মুহাম্মদ!
আমার হৃদয়ের ধুলোয় পা রেখে হেঁটে যান প্রিয়তম পথিক
আমার চোখের অশ্রুতে ধুয়ে দেই আপনার পদছাপ
আমার ঠোঁটের লফজে অর্পণ করি তড়পানো আত্মার দস্তরখান গ্রহণ করুন
হে মক্কার মুহাজির, মুহাম্মদ!
(হাজার বছরের ভালোবাসা)

এই সেই পারস্য-সাহাবি সালমান ফারসির হৃদয়ভরা রোদন। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে তার নিরন্তর অপেক্ষা। বারবার তার ক্রীতদাস-জীবনের হাতবদল, শেষে মদিনার কোবাপল্লিতে থিতু হওয়া—প্রিয়তম পথিকের সাক্ষাৎ-পাওয়া।…

১.৫
নবী মুহাম্মদ, আমার কি একবার মেরাজ হবে?
আমিও বেলালের পায়ের ধ্বনি শুনতে চাই
অতল বেহেশতের বারান্দায় এক তড়পায় আমারও সবুজ প্রাণ,
আমাকে একবার কিনে নাও, একটিবারের জন্য
একা দাসবাজারে এক রাতের মেরাজ
দাঁড়িয়ে আছে এক নিষ্পাপ ক্রীতদাস—
আমাকে তুমি একটিবারের জন্য কিনে নাও।

এ যুগের কবি রাসুলের (স.) সোহবত পাননি। তবে ক্রীতদাস বেলালের মতো নবীর গভীর আত্মিক স্পর্শ তিনি চান—সেই হৃদয়-নিঙড়ানো অতৃপ্ত কামনা বিচ্ছুরিত হয়েছে এ কবিতার পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে। এক কান্নাঝরা আর্তিতে প্লাবিত হয় পুরো কবিতার পরিধি।

১.৬
কল্পনাকাতর কবি ফিরে যান চার হাজার বছর পেছনে। যা ইতিহাসের ধূসর প্রান্তর। পিতা ইব্রাহিম-নির্মিত কাবার রহস্যময় সফেদ আঙিনায় তিনি হাঁটেন। মাতাফে। রুহের জগতে কবিও ইব্রাহিমের আহ্বান, বিনীত স্বনন শুনতে পেয়েছিলেন। তাই হজের শ্বেতশুভ্র ইহরাম পরে হাজির হন কাবায়। কবি মগ্ন চৈতন্য দিয়ে অনুভব করেন পিতার কোমল-পেলব স্পর্শ । তার আপাত সন্নিধি তাকে উতলা করে তোলে। তখন স্বগত উচ্চারণ করেন কবি :
ইব্রাহিম,
হাত রাখো আমার আত্মার গিলাফে
আমার বুকের জিকিরগাহে কান পাতো নিরালায়
শুনতে পাও, শুনতে পাও আমার লাব্বয়িক ধ্বনি?…

১.৭
এক-একটি কবিতার শব্দনির্বাচনে কবি অত্যন্ত দক্ষ, কুশলী কারিগর। বিষয়কে শিল্পিত করার জন্য শব্দরা শানিত হয়, উচ্চকিত হয়ে ওঠে বারবার। তাই নানান রং-বেরঙের শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে কবিকে। তৎসম-তদ্ভব-আরবি-ফারসি-উর্দু-ইংরেজি-লোকজ শব্দরা মুখর হয়ে ওঠে। কখনও দেখা যায় কুরআনের আস্ত-খণ্ডিত আয়াত এসে জায়গা নেয় প্রাসঙ্গিকভাবে :

• আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির (শূন্যতার দিকে)

• লা তাখুজুহু সিনাতুঁ অলা নাউম (মৃত্যুসাধ)

• ওয়ামা মুহাম্মদুন ইল্লা রাসুল (ইজখির ঘাস)

• নাহানু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল অরিদ (পরপারে)

১.৮
কাব্যের বেশিরভাগ কবিতাই অমিল অক্ষরবৃত্তের। অতি আধুনিক। মাত্রা-পর্ব-যতি-ছেদের বিন্যাস সুরক্ষিত করার সুযোগ নেই। তবে দু-একটি ব্যতিক্রমও আছে :
এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা সব হয়ে যাবে একাকার
দস্তর হবে খোদার কুরআন—কুরআনই ইশতেহার।
(পাষাণী মরমের বাসনা)

উপমা :
… প্লাবনের মতো হৃদজিকিরের কাতরধ্বনি… (ঈশ্বর আসেন কথাবার্তা বলি)

মাথার ভেতর কাচের ছুরির মতো বিধে স্মৃতি (মৃত্যুর অপারগতা)

চিত্রকল্প :
ইব্রাহিম দাঁড়ালেন মাকাম পাথরে
অস্বচ্ছ পরম দৃষ্টিতে তাকালেন ইয়ামেনি আকাশে
আর… (কাবার ডাক)

ভাবনার বিসঙ্গতি :
কেন মানুষ মরে গেলে—
হৃদয় পৃথিবীতে কখনো আর ভোর আসে না?
কেন অন্ধকার ডেকে ডেকে বলে—
আমি আর আসব না, ফিরে আসব না…?
(মৃত্যুর অপারগতা)

রূপক :
• হাত রাখো আমার আত্মার গিলাফে। (কবার ডাক)
• আকণ্ঠ করেছি পান কাউসারের সরোবর। (কিরামান কাতিবিন)

উৎপ্রেক্ষা :
ইবনে মাসউদ, তোমার কণ্ঠে কুরআনধ্বনি
আলোক হয়ে ঝরে যেন আমার কবরঘরে
(রাদিয়াল্লাহু আনহুম)

১.৯
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কবিতাগুলো বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। এদের নিয়ে রকমারি কারুকাজ, শব্দ-পঙ্‌ক্তির নিপুণ সজ্জা এবং তাপিত ভাবনার ব্যঞ্জনা মুগ্ধ করে। ইতিহাসের কোনো কোনো ভাবনার রুক্ষ প্রান্তরে আবেগের বিভা ছড়ায়, রোমান্টিক থেকে কবিকে মিস্টিক করে তোলে। এক অজানা মৌতাত আমার মতো অভাজন পাঠককেও প্রলুব্ধ করে।

১৬.১২.২০২২
কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কাব্য : ঈশ্বর আসেন কথাবার্তা বলি
লিখেছেন: এস. এম. হারুন-উর- রশীদ স্যার

Leave a Reply

Your email address will not be published.