সাধারণত সকালে লিখি, ফজরের পর। গতকালের কথাবার্তা যা জমা থাকে, রাতের ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে যতটুকু স্মৃতি রয়ে যায়, সকালের ঝুড়িতে সেটুকু লিখে রাখার কোশেশ করি।
গতকাল উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য আমার জীবনে এমনিতেই তেমন কোনো ঘটনা ঘটে না, সাধারণ গড়পড়তা জীবন। আমি বরং সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণ করে বর্ণনা করি। বর্ণনাটাই আসল। যারা অনলাইনে নানা প্রকার পণ্য-প্রোডাক্ট বিক্রি করেন তারা আমার কথার গুঢ়ার্থ বুঝতে পারবেন। আপনার প্রোডাক্ট কী বা কেমন সেটা ক্রেতাকে বড় একটা আকৃষ্ট করবে না, আপনি আপনার প্রোডাক্ট ক্রেতার সামনে কীভাবে উপস্থাপন করছেন সেটাই ক্রেতাকে আগ্রহী করবে। কারণ, ক্রেতা হাত এবং চোখ দিয়ে আপনার প্রোডাক্ট দেখে-শুনে যাচাই করতে পারছে না। আপনার উপস্থাপনার অভিনবত্ব, গুণগত মানের বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রোডাক্টের নতুনত্ব ক্রেতাকে স্থিরচিত্ত করবে প্রোডাক্ট খরিদ করতে।
ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করে বলি। ধরুন, আপনি অনলাইনে সালোয়ার-কামিজ বা পাঞ্জাবি বিক্রি করবেন। ফেসবুক/অনলাইনে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আছে হাজার হাজার। নামী-দামী কোম্পানি থেকে শুরু করে কুষ্টিয়ার অজপাড়া গাঁয়ের একটা মেয়েও সালোয়ার-কামিজ বিক্রি করছে, তো আপনার কাছ থেকে কেন সালোয়ার-কামিজ কিনবে ময়মনসিংহের এক গৃহবধূ?
আপনি একটি কামিজ বানিয়ে ভালো ক্যামেরা দিয়ে সেটির ছবি তুলে ডেসক্রিপশনে লিখুন, ‘কামিজের ডিজাইনগুলো সব হ্যান্ডমেইড, আপনি/আপনার কারিগর হাত দিয়ে ডিজাইনগুলো করেছেন, কোনো প্রকার মেশিনের সাহায্যে ডিজাইন করা হয়নি। এমনকি ডিজাইনের সুতোগুলো আপনি সরাসরি তাঁতীদের থেকে কিনে এনেছেন, এগুলো স্পিনিং মিলের সুতো নয়। সুতোও তাঁতীদের হ্যান্ডমেইড, স্বহস্তে তৈরি।’
এটা হচ্ছে আপনার প্রোডাক্টের অভিনবত্ব। একই সালোয়ার-কামিজ, কিন্তু আপনি একটু ভিন্নভাবে/নতুনভাবে সেগুলো তৈরি করেছেন এবং ভিন্নভাবে ক্রেতার সামনে উপস্থাপন করেছেন। ক্রেতা আকৃষ্ট হবে।
একই কথা লেখালেখির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুনিয়ায় প্রেম-ভালোবাসা, রাজা-বাদশাহর ইতিহাস নতুন করে আর কিছুই তেমন ঘটবে না। কিন্তু ওই ঘটমান ঘটনাকেই আপনার উপস্থাপন করতে হবে অভিনব ভাষাশৈলী এবং আকর্ষণীয় বাক্যনির্মাণের উৎকর্ষে। নইলে আপনি হাজারো লেখকের ভিড়ে হারিয়ে যাবেন, অভিনব কেউ হতে পারবেন না।
***
গতকাল শুক্রবার ছিল। বউ নাইওর গেছে। বউ কাছে না থাকলে বিবাহিত পুরুষমাত্রই এক ধরনের অসহায়ত্ব বোধ করে, এক ধরনের শূন্যতা। এই শূন্যতাবোধ বড় খারাপ জিনিস। কেবল শারীরিক সম্পর্ক নয়, দুজনের নির্ভরশীলতার যে ব্যাপার সেটা কথা বা অক্ষর দিয়ে বুঝানো সম্ভব নয়। এই সিচুয়েশন কেমনে বুঝাই আপনাদের! যাক, বাদ দেন এই প্রসঙ্গ।
জুমআর নামাজের আগে কয়েকদিনের পরা কাপড়গুলো ধুয়ে দিলাম। আমার নিজের কাপড় সবসময় আমি ধুই। বউকে দিয়ে কখনো কাপড় ধোয়াই না, মাকে দিয়ে তো নয়ই। বরং মা-বাবার কাপড়ও মাঝে মাঝে আমি ধুয়ে দেই। এটা তো আমার দায়িত্ব, আমি তাদের সন্তান হিসেবে তাদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব আমার। এগুলো বউয়ের দায়িত্ব না, আমার সূত্র ধরে তার ওপর দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু আমিই যদি মা-বাবার কাপড় ধোয়ার দায়িত্বটা আঞ্জাম দিতে পারি তাহলে বউয়ের ওপর কেন বোঝা চাপাবো?
অনেকে মনে করছেন শুচিবায়ুতার কারণে আমি অন্যকে দিয়ে আমার কাপড় ধোয়াই না। না, কোনো সুচিবায়ুতার জন্য নয়, এটা দুজনের বোঝাপড়া। নিজের কাপড় ধোয়ার সক্ষমতা যেহেতু আমার আছে তাহলে আমি সেটা বউকে দিয়ে কেন ধোয়াবো? যে কাজ আমি করতে পারি সেটা আরেকজনকে দিয়ে করানোর মধ্যে তো কোনো বাহাদুরি নেই। যারা নেতা হতে চান, তারা এ বিষয়টা খেয়াল রাখবেন। আপনি যে কাজ নিজে করতে সক্ষম সেটা কখনো আপনার কর্মীকে দিয়ে করাবেন না। এক কাপ চা-ও যদি আপনি নিজে কিচেন বা দোকান থেকে এনে খেতে পারেন তাহলে সেটার জন্য কর্মীকে আদেশ দেবেন না। একজন নেতা সকল কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়, অন্যের ওপর শুধু দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় না। এ কারণে সকল কাজে তার অংশগ্রহণ সর্বাগ্রে হওয়া উচিত।
তো বলছিলাম যে, দুনিয়ার আকছার পুরুষ বউকে দিয়ে নানা কাজ করানোকে নিজের বাহাদুরি এবং তার প্রতি স্ত্রীর বাকবাকুম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মনে করে—‘আর বলিস না, বউ তো আমাকে কোনো কাজই করতে দেয় না, চায়ের কাপটা পর্যন্ত মুখে তুলে দেয়। ভালোবাসা বুঝলি, ভালোবাসা…!’
এর নাম ভালোবাসা নয় মাই ডিয়ার, কখনো কখনো এগুলো স্পষ্ট জুলুমের পর্যায়ে পড়ে। ভালোবাসার নামে আপনি তার ওপর জুলুম করছেন। সে আপনার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আপনার সব কাজ করে দিচ্ছে, আপনি কখনো ভালোবেসে তার কাজ করে দিয়েছেন? তার জন্য রান্না করেছেন? তার কাপড় কেঁচে দিয়েছেন? ঘর মুছে দিয়েছেন? ঘরের সব কাজ তো সে-ই করছে, আপনি কী করছেন? ও আচ্ছা, আপনি তো অফিসে কাজ করে এসেছেন, বাইরে ব্যবসাপাতি সামলে এসেছেন, এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত শ্রান্ত, আপনি আবার ঘরের কাজ করবেন কীভাবে? একবার বউয়ের হাত দুটো চোখের সামনে তুলে দেখুন, হলুদ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে সেগুলো। জন্ডিস না, হলুদ-মরিচের অক্ষয় দাগ। প্রতিটি আঙুলে কত কাটাকুটি দাগ, প্রতিদিন সবজি কাটতে হয় তো আপনার আর আপনার পরিবারের উদরপূর্তির জন্য। হাতের তালুর চামড়াগুলো উঠে গেছে, ভালোবেসে প্রতিদিন আপনার/আপনার সন্তানদের এঁটো জামা-কাপড় ধুতে হয় তো।
***
গতকাল ফেসবুকে এক মাওলানা বার্তা দিলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। ঢাকার চাকরি ছেড়ে গ্রামে আছি আপাতত। মসজিদে ইমামতি নিয়েছি। সাথে আপনার মত করে একটা কিন্ডারগার্টেন করার ইচ্ছা, কিভাবে শুরু করতে পারি, কি কি পদক্ষেপ নিতে পারি একটু পরামর্শ দিলে উপকার হত।’
আমি আপনাদের আগেই বলেছিলাম, আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে মহল্লায় একটা করে মকতবস্কুল প্রতিষ্ঠা হোক। প্রতিটি বাড়ির প্রত্যেকটি সন্তান যেন শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারে এবং ইসলামের ফরজিয়্যাত বিধানগুলো ওই ছোট বয়সে শিখে নিতে পারে, এটা আমাদের লক্ষ্য। ছোটদের কাদামাটি মন, ওখানে যদি ওই নরম বয়সে একবার কুরআনের ধ্বনি বসিয়ে দেয়া যায় সেটা আজীবন গুঞ্জরিত হতে থাকবে। সুতরাং নিজের এলাকায় এমন একটি মকতবস্কুল প্রতিষ্ঠা করা প্রত্যেকজন আলেম এবং ইসলামপ্রিয় সচেতন মানুষের আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করি।
ওই মাওলানাকে প্রাথমিক যে পরামর্শ দিয়েছিলাম সেগুলো আপনাদের সঙ্গেও শেয়ার করি, যারা এমন মকতব শুরু করতে চান তাদের জন্য উপকারী হবে আশা করি!
১. ছাত্রদের পড়ানোর জন্য একটা স্থান নির্বাচন করুন। কোনো ঘর বা ঘরের বারান্দাও হতে পারে। (প্রথমেই নতুন ঘর বা বিল্ডিংয়ের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, নিজের সাধ্যে যেটুকু আছে সেখান থেকেই শুরু করুন।)
২. নুরানী কায়দা দিয়ে সবার কুরআন পাঠদান শুরু করুন প্রথমে। (আমরা একটি ভিন্ন কায়দা দিয়ে পড়াই, যেটির নাম ‘কায়দা : লিতা’লীমিল ফুরকান’, মারকাযুল ফুরকান লালবাগ থেকে প্রকাশিত। যেহেতু নুরানী কায়দাগুলো সহজলভ্য তাই এটিই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে আমরা শিশুদের পাঠদানের ওপর দীর্ঘ গবেষণার পর নতুন একটি কায়দা প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছি। শিগগিরি এটি প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ!)
৩. ইসলামি কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন প্রকাশনীর ক্লাসওয়ারি বাংলা-ইংরেজি-অংক-আরবি বই আছে, বইগুলো সংগ্রহ করে ক্লাসওয়ারি ছাত্রদের দেন। বইগুলো পারলে কেনা দামে তাদের কাছে বিক্রি করুন। প্রাথমিকভাবে ইমপ্রেস করার জন্য ফ্রিও দিতে পারেন, যদি আপনার সামর্থ্য থাকে। (বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখব একদিন। কোনো প্রকাশনীর বই-ই আমার কাছে বাচ্চাদের উপযোগী মনে হয়নি। এগুলো এসময়কার বাচ্চাদের উপযোগী নয় এবং বিজ্ঞানসম্মতও মনে হয়নি আমার কাছে। ইচ্ছা আছে, আরও গবেষণার পর মকতবস্কুলের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল বই আমরা নিজেরাই প্রণয়ন করব ইনশাআল্লাহ!)
৪. ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য হোয়াইট বোর্ড বা ব্ল্যাক বোর্ডের ব্যবস্থা করুন। আর সবার জন্য শ্লেট-চকের ব্যবস্থা করুন। পড়ানোর পাশাপাশি তাদের লেখার মশক করাতে হবে। বাড়ির কাজের জন্য অবশ্যই হাতের লেখা দিতে হবে।
৫. প্রথমে আপনি ছাত্র-ছাত্রী কালেক্ট করতে গেলে সেখানে বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র পাবেন, নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রি…। আপাতত ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী নেন।
৬. তারা আগে কোন ক্লাসে পড়েছে, সে হিসাবে তাদের ভাগ করে ফেলুন এবং সেভাবে জেনারেল বিষয়গুলো পড়ান। সকল ক্লাস মিলিয়ে আরবি পড়ানোর জন্য দুটো দল করুন। যারা একটু ভালো পারে তাদের একটা দল, আর একদম ছোটদের জন্য একটা দল। এভাবে দুটো দলকে আরবি আলাদা আলাদাভাবে পড়াতে থাকুন।
ওই মালানাকে প্রাথমিকভাবে এটুকুই পরামর্শ দিয়েছি। ব্র্যাকেটবন্দি লেখাগুলো নতুন করে সংযুক্ত করে দিলাম। আশা করি আপনাদের জন্যও এ দাওয়াই ফলপ্রসূ হবে। যারা এমন কিছু করতে চাচ্ছেন, শুরু করে দিন। প্রথমে পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শুরু করুন, হতাশ হবেন না। আপনার সৎসাহস এবং অন্তরে ভালোবাসা থাকলে সফল হবেনই।
আজ সকালে আমাদের ধামরাইয়ের সুতিপাড়া গ্রামের আরেক মাওলানা ফোন করলেন। তিনি সম্ভবত ফেসবুকে আমার কার্যক্রম দেখেছেন, এখন নিজেও এমন একটি মকতবস্কুল করতে আগ্রহী। মজার ব্যাপার হলো, কে যেন তাকে ভুল তথ্য দিয়ে আমার শশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আমার বাড়ি নাকি ওই গ্রামে। সেখানে সৌভাগ্যক্রমে আমার শশুরের সঙ্গে বাতচিত হওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমাকে কল করেছিলেন। অনেকক্ষণ কথা হয়েছে মাওলানার সঙ্গে।
দোয়া করি, এই দুই মাওলানার প্রচেষ্টা আল্লাহর ফজলে সফল হোক। বাংলার প্রত্যেকটি শিশু কুরআনি শিক্ষায় শিক্ষিত হোক।