শাইখুল ইসলাম দরবেশ তকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তৎকালীন মিশর ও দামেশকের সুলতান কর্তৃক তিনবার গ্রেফতার হন। তিনবারই তাকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল খাটতে হয়। তার অপরাধ ছিল—ভ্রান্ত বিশ্বাসী, বিদআতি ও মাজারপূজারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সত্যভাষণ।  এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে তৎকালীন শাসকবর্গের বেশ দহরম মহরম ছিল। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক ইসলামের সত্য উন্মোচনের ফলে তারা ইমামের বিরুদ্ধে সুলতানকে প্ররোচিত করে এবং তাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরতে সব রকম সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় দফায় ইমাম ইবনে তাইমিয়া মিশরে প্রায় দুই বছর কারান্তরীণ থাকেন। মুক্তির পর তিনি দামেশকে ফিরে এসে শিক্ষাদান ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। এ সময়কালে তার শত্রুদের অন্যতম এক বিদআতি আলেম মৃত্যুবরণ করেন। জীবিতাবস্থায় যিনি ইমামের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, নানাভাবে কষ্ট দিয়েছেন এবং তাকে জেলে পাঠানোতে তার সহযোগিতা ছিল অন্য অনেকের চেয়ে অধিক।

ইমামের শাগরেদ হাফিজ ইবনে কাইয়ুম ওই আলেমের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসে বললেন, ‘শাইখ, আপনার অমুক শত্রু তো আজ মারা গেছে। সে অনেক কষ্ট দিয়েছে আপনাকে। আপনার বিরুদ্ধে হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই যাতে তার হাত ছিল না। আপনি তার জন্য বদদোয়া করুন!’

ইমাম তার শাগরেদকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন এবং ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলেন। তিনি শাগরেদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তার সঙ্গে আর কোনো কথাই বললেন না।

ইমাম সেখান থেকে জলদি উঠে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। কয়েকজন শাগরেদকে নিয়ে হাজির হলেন মৃত আলেমের বাড়িতে। তিনি তার মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করলেন। তার পরিবারের লোকজনের কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কোনো চিন্তা করো না। তিনি চলে গেলেও আমি তো বেঁচে আছি। তোমাদের যখন যা প্রয়োজন হবে, আমাকে বলবে। আমি তোমাদের সকল প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করব।’

ওই আলেমের পরিবারের লোকজন তার আগমন এবং তার হৃদ্যত্বপূর্ণ সান্ত্বনাবাক্য শুনে অবাক হয়ে গেল। তারা চিন্তাই করতে পারেনি ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার অন্যতম শত্রুর জানাজায় আসবেন এবং তার পরিবারকে এভাবে সান্ত্বনা দেবেন। তারা প্রাণ খুলে ইমামের জন্য দোয়া করলেন।

দরবেশ ইবনে তাইমিয়ার জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে দামেশক দুর্গে কারান্তরীণ অবস্থায়। এই দুর্গের একটি কক্ষে তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

প্রায় দুই বছর কারান্তরীণ থাকার দরুণ তিনি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এ সময় দামেশকের গভর্নর আসেন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি তার শয্যাপাশে এসে বলেন, ‘আমার দ্বারা কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষমা করবেন।’

জবাবে ইমাম বলেন, ‘আমি আমার পক্ষ থেকে আপনাকে ক্ষমা করেছি এবং তাদেরও ক্ষমা করে দিয়েছি যারা আমার সঙ্গে নানা সময়ে শত্রুতা করেছে। আমি সুলতানকেও ক্ষমা করে দিয়েছি যিনি আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। তার ব্যাপারেও আমার কোনো অভিযোগ নেই। ক্ষমার অযোগ্য তো কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দুশমন।’

এর কয়েকদিন পরই দরবেশ তকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশ দুর্গেই কারান্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তারিখটি ছিল ২২ জিলকদ ৭২৮ হিজরি মোতাবেক ২৮ সেপ্টেম্বর ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ।

সূত্র: সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৯ ও ১৭৯, সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি, আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী ও হাফেজ আবু তাহের মেছবাহ্ অনূদিত


Leave a Reply

Your email address will not be published.