নারায়ণ শীল আমার তিন পুরুষের চুল কেটেছেন। পিতামহ, পিতা এবং আমার। রোগা লিকলিকে ফরসা ধুতিপরা লোকটা প্রতিদিন সকালে হেঁটে যেতেন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। হাতে থাকতো একটা খাকি কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর গোছানো থাকতো কাঁচি, ক্ষুর, কম দামি বলাকা ব্লেড, এক খন্ড সাদা ফিটকিরি, ছোট আয়না, সাদা কাপড়, পানি রাখার পিতলের ছোট বাটি, এক টুকরো কসকো সাবান এবং নিজস্ব একটা পিঁড়ি। সঙ্গে পুরোদস্তুর ভ্রাম্যমাণ সেলুন নিয়ে নারায়ণ শীল মাথা নিচু করে হেঁটে যেতেন গ্রামের পথ ধরে। যে বাড়ির লোকদের চুল বাড় বেড়ে যেতো, তারা ডাক দিতো—ও কাহা, এমকি আহো! আমাগো গেদার চুলডি কাইটা দিয়া যাও।
নারায়ণ শীল বড় একটা কথা বলতেন না কারো সঙ্গে। মাথার চাঁদিতে চুলে পাক ধরেছিল। তাঁর দৃষ্টি ছিল ধুসর। লম্বা লোকটা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, মনে হতো, ন্যুব্জ একটা খেজুর গাছ পৃথিবীর জরা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে লোকালয়ের শেষ প্রান্তের দিকে। পথের ধুলোর দিকে তাঁর কোনো সম্ভ্রম ছিলো না, সবুজ-পাখিদের কুজনে তাঁর কোনো আফসোস ছিলো না, পুকুরঘাটে স্নানরত গেরস্তবাড়ির নারীদের ব্যাপারে তাঁর কোনো সংবাদ ছিলো না, সন্ধেবেলা বেজে ওঠা উলুধ্বনিতে তাঁর কোনো বেদনা ছিলো না; তাঁর কানে কেবল গীতাপাঠের মতো গুঞ্জরিত হতো কাঁচির ক্যাচ ক্যাচ চুলকাটার পুণ্যপাঠ। হাটবারে চালের দাম বেড়ে গেলে তাঁকে হাঁটতে হবে বাড়তি আরও দুই মাইল, পাড়ি দিতে হবে তিনটি গ্রাম। নারায়ণ শীল দেবতাদের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ কর্তিত চুল কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে চান আমরণ স্বর্গে। মানুষকে পবিত্র করার প্রমাণপত্র কাঁধে নিয়ে যে মহত্তম পুরুষ হেঁটে যান মর্ত্যলোকের মৃত্তিকাপুরাণে, তিনি কি তেত্রিশ কোটি দেবতাদের একজন নন? অথচ নারায়ণ শীল হয়তো পুনর্জন্মে স্কুলের হেডমাস্টার হতে চাইতেন!
আমার পিতামহ সপ্তাহ দু-এক বাদে বাদেই নারায়ণ শীলের ক্ষৌরকর্মের দ্বারস্থ হতেন। রাস্তা থেকে পিতামহের ডাক শুনে নারায়ণ শীল দুয়ারে গিয়ে বসতেন পিঁড়ি পেতে। আস্তে আস্তে খাকি ব্যাগটা খুলে বের করতেন তাঁর সকল হাতিয়ার। পিতলের বাটিতে ঢালতেন খানিকটা জল, ফিটকিরিতে ঘষে নিতেন হাত দু-একবার, সাদা কাপড়টার ভাজ ভেঙে চড়িয়ে দিতেন পিতামহের গলায়। পিতামহ মাথা নিচু করেই খুটখাট খুচরা সওয়াল করতেন নারায়ণ শীলকে-
‘বল্লভের পোলায় নাকি বিয়া করছে রে নারায়ণ?’
‘হ, করছে হেদিন।’
‘পরেশের বাইল্যাপাড়ার ক্ষ্যাতে নাকি ইবার ভালো ধান হইছে?’
‘আইতের সময় তো দেখলাম, ভালোই।’
‘উমমম…!’
চুল কাটা বাদেও দাড়ি-গোঁফ, ওই বগলের তলাটা সাফ-সুতরো করতেন দুয়ারে বসেই। সাদা কাপড়ে লেগে থাকা চুল, দাড়ি-গোফ ঝেরে পরিস্কার করে নিতেন এক ফাঁকে। পিতামহের জরুরত শেষ হলে তিনি এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজতেন তাঁর পৌত্রদের। না পেলেই বাজখাঁই গলায় হাঁক ছাড়তেন—‘কই রে জামিল শামীম মোশা মনির জাহাঙ্গীর…!’ পাঁচ ছেলের ঘরে সাতজন। স্কুলে যায়। যাওয়াই সার, সারাদিন বিল-পুকুরে সাঁতার আর মাছ ধরা, আম-বড়ই চুরি, পাখি ধরা, গোল্লাছুট-দড়িয়াবন্ধা, মারামারিতেই তাদের যতো হাতযশ। সন্ধেবেলা বই নিয়ে বসলেই তাদের চোখে ধরা দেয় রাজ্যের মনোহরী ঘুম।
পিতামহের ডাকে আমরা নিমরাজি হয়ে নারায়ণ শীলের সামনে বসতাম। বাজারে তখন কেবলই দুয়েকটা সেলুন লেগেছে। বিরাট বিরাট আয়না, সামনেরটাতে চোখ রাখলে পেছনটাও দেখা যায়। গদিঅলা ঘুরন্তি চেয়ার। আমাদের খায়েশ ছিল সেই ঘুরন্তি চেয়ারে বসে চুল কাটার। কতো নায়কদের স্টাইলিশ কাটিংয়ের ছবি সাজানো আয়নার সামনে। কল্পনায় নিজের মাথাটা নায়কের মাথা মনে হতো। কিন্তু মাসান্তে নারায়ণ শীল এসেই গণ্ডগোলটা বাঁধাতো। তাঁর সামনে বসতেই লম্বা লম্বা দুই হাঁটু দিয়ে দু’দিক থেকে ঠেসে ধরতেন মাথা। পিতামহের ট্রেডমার্ক ‘বাটি ছাটনি’ ছিলো আমাদের কপাললিখন ‘একদম মাটি হুমান কইরা দিবি নারায়ণ!’ পিতামহের দিক-নির্দেশনায় চুল কাটা শেষ হলে নারায়ণ শীলের হাঁটুর নিচ থেকে বের হতাম কদম ফুলের মতো তীক্ষ্মকেশ মাথা নিয়ে। পিতামহ খুশি হয়ে দুই-চার মাথার জন্য শীল দাদার হাতে ধরিয়ে দিতেন বিশ টাকা। নারায়ণ শীল কখনো নাখোশ হতেন না।
বহুদিন হলো নারায়ণ শীলকে দেখি না আমি। শুনেছি, আজকাল অসুস্থ খুব। বার্ধক্যের জরায় চোখে দেখেন না আর। দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। চুলের মতো কালো অতল অন্ধকারে কেবল খা খা শূন্যতা। তিন আঙুলে বিশেষ কায়দা করে ধরা কাঁচির হুড়কোয় জং ধরে গেছে তাঁর। সেই খাকি ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর গলায় বাঁধবার সাদা কাপড়, এক খণ্ড ফিটকিরি, ধারালো ক্ষুর, পিতলের বাটিতে রাখা পবিত্র জল; সব কিছু অনিন্দ্য চুপচাপ। ভাবছি, একবার দেখতে যাবো তাঁকে। শৈশবের সেই নারায়ণ দাদা আজ দৃষ্টিহীন, অথচ তাঁরই চোখে দেখবার কথা ছিলো সবচে বেশি।
নারায়ণ দাদার ছেলে নরেন্দ্র কাকাও বাবার মতো ফেরি করে চুল কাটে, এখনও। সনাতন ধর্মে সম্ভবত এমন কোনো দর্শন আছে—বংশীয় পেশা ধরে রাখার। নইলে এ যুগে কে গ্রামে গ্রামে হেঁটে চুল কাটতে যায়! নরেন্দ্র কাকা পিতার স্মৃতিপেশা ধরে রেখেছেন। তাঁকে দেখলেই আমার নারায়ণ দাদার কথা মনে হয়।
আমি ডাক দেই— কাহা, কেমন চলছে?
নরেন্দ্র কাকা সামনের ফাঁকা দাঁত লুকিয়ে হাসে। যদিও তাঁর পিতা কোনোদিন জানবেন না, আমার শৈশবের অখ্যাত স্মৃতিতে তিনিও আছেন একজন মহান হয়ে। থাক, সব কথা মহানদের গোচরে থাকতে নেই। কিছু কথা মহানদের অগোচরে রয়ে যাক। কিছু স্মৃতি হোক, কিছু বিস্মৃত।