আমাদের দেশের ধর্মীয় সমাজে ইবনে তাইমিয়া, শাইখ আলবানি, সাইয়েদ কুতুব (রহিমাহুমুল্লাহ) ও অন্যান্য অধুনা আরবীয় শাইখদের নাম যতবার উচ্চারিত হয়, শামছুল হক ফরিদপুরী, হাফেজ্জী হুজুর, মুহিউদ্দীন খানের (রহিমাহুমুল্লাহ) নাম ততবার উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না? শামছুল হক ফরিদপুরীর শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি? কেন হাফেজ্জী হুজুরের আধ্যাত্মবাদ ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয় না? কেন ইসলামি প্রকাশনা ও পুস্তক আন্দোলন নিয়ে মুহিউদ্দীন খানের নিরলস ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা আমাদের মুখে উচ্চারিত হয় না?

কারণ, বিগত বছরগুলোতে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, আরবী শাইখদের প্রবর্তিত ইসলাম হচ্ছে পিউর ইসলাম, আর আমাদের এ দেশীয় পূর্বসূরীদের ইসলাম হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ ইসলাম। এই প্রবণতা ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আমরা হচ্ছি ‘না ঘর কা না ঘাট কা’। হচ্ছি কেবল আরবদের নকলনবিশ।
আমাদের প্রকাশনাগুলোর অবস্থা নিতান্ত শরমজনক। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এত ছ্যাচড়া হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, দুই টাকা লাভ না হলে কোনো বই প্রকাশ করে না। যেদিকে রোদ দেখে সেদিকে পাছা সেঁক দিয়ে মনে করে, এই তো দ্বীনের হেফাজত করে ফেললাম। দায়িত্ববোধ, স্বজাত্যবোধ, নিজস্বতা, নতুন চিন্তা নিয়ে তাদের কোনো ফিকিরই নেই।
সালাফদের নাম নিয়ে এন্তার বই বেরুচ্ছে। সেসব বইয়ে সকল সালাফ (পূর্বসূরী) কেবলই আরবের। এই বঙ্গ অঞ্চলের কোনো সালাফের জীবনাচার সেখানে স্থান পায় না। কেন? শামছুল হক ফরিদপুরী, হাফেজ্জী হুজুর, পীরজী হুজুর, আবদুল ওয়াহাব হাটহাজারী, মুশাহিদ বায়মপুরী—এদেরকে কেন সালাফ মনে হয় না? এদের সালাফ মনে করতে আমাদের এত কষ্ট হয় কেন? এরা বাঙালি বলে? এরা এই দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তরে নিজেদের জীবন-যৌবন একাকার করে দিয়েছিলেন বলে? তারা আরবে গিয়ে দ্বীন প্রচার করলে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতেন?
আমাদের মাদরাসাগুলোর অবস্থা যেন আরও কূল-কিনারাহীন। মাদরাসাগুলো জানেই না কেন এ মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আর কারা এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদরাসাগুলো বড় শান-শওকত নিয়ে দেওবন্দিয়্যাতের কথা বলে। কিন্তু তারা দেওবন্দিয়্যাত বলতে কেবলই ভারত-পাকিস্তানের আলেমদের তোষামোদী করে। এই দেশে দেওবন্দিয়্যাতের ধারা যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের কথা আমাদের মাদরাসাগুলোতে চর্চা হয় না। তাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।
আরও দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের মাদরাসাগুলোতেও স্বজাত্যবোধ বা জাতীয়তার চিন্তাকে দোষণীয় মনে করা হচ্ছে। নিজেদের নিজস্বতা জলাঞ্জলি দিয়ে তারাও মাথায় রুমাল আর গায়ে আবায়া পরে নিজেদের ‘উস্তাজ’ সাজাতে উঠে পড়ে লেগেছে। মাদরাসাগুলো যে নিজস্ব চিন্তার দৈন্যে ভুগছে, যে কোনো মাদরাসার ক্লাসরুমে কান পাতলে সেটা স্পষ্ট শুনতে পাবেন।
এখন আরেক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বজাত্যবোধের কথা বললে অনেকে এটাকে আসাবিয়্যাত-এর (জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা) দোষে দুষ্ট বলেন। অথচ একটু তালাশ করে দেখেন, সবচে বেশি আসাবিয়্যাত রয়েছে আরবদের মধ্যে। সেই সুদীর্ঘ কাল ধরে আরবরা তাদের নিজেদের জাতীয়তা (আসাবিয়্যাত) নিয়ে গর্ব করে আসছে এবং এখনও তারা সেই গৌরব সযত্নে সংরক্ষণ করে চলে। আর আমরা স্বজাত্যবোধ বা জাতীয়তা দেখালে সেটা হয়ে যায় ক্ষুদ্রতা, প্রান্তিক আজমী চিন্তা-ভাবনা।
মনে রাখবেন, আমাদের বঙ্গীয় সালাফরাই এই বঙ্গে ইসলাম সুরক্ষা করেছেন। এরাই যুগ যুগ ধরে পরিতোষণ করেছেন বলে ইসলাম এখানকার নব্বুই ভাগ মানুষের ধর্ম। লাখ লাখ মসজিদের মিনারে নির্ভীক সুরে প্রতিদিন পাঁচবেলা আজান হচ্ছে। প্রতিদিন বাংলার শত শত জনপদে বিরাট জশন নিয়ে ওয়াজ-মাহফিল হচ্ছে। প্রতিদিন বাংলার কোথাও না কোথাও নতুন করে একটি মাদরাসার গোড়াপত্তন হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত ইসলামি পুস্তকাদি প্রকাশ হচ্ছে ইসলামের নামে। তাদের এই অপরিশোধ্য অবদানকে অবহেলা করলে এখানে ইসলামের অরিজিন বিনষ্ট হয়ে যাবে।
আপনারা যারা আরবী শাইখ-সালাফদের এদেশে আমদানি করে নিজেদের লাভের আখের গুছাচ্ছেন, মনে রাখবেন, কিছুদিন পর আপনারা আমও হারাবেন ছালাও হারাবেন। কাক হয়ে কোকিল সাজতে গিয়ে কানাকুকা হয়ে ঘরে ফিরবেন।