‘একজন কাপুরুষের শেষ আশ্রয় হলো দেশপ্রেম।’ অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য সমালোচক, ব্যকরণবিদ স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন এমন কথা। শুনতে নিষ্ঠুর মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত সামাজিক গভীরতা নিদারুণ সত্য। পৃথিবীর মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে দেশের গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করা একধরনের কাপুরুষতাই বটে। ধর্ম ব্যাপারটিও এর থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। কেননা সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে দুটোই সমান অংশীদার। ধর্ম যেমন মানুষকে আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত করে তেমনি উগ্র জাতীয়তাবাদও মানুষকে সাম্প্রদায়িকই করে, সভ্য করে না।

সুতরাং সম্প্রদায় থাকলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই। সেটা ধর্মের লেবাস পরে হোক কিংবা দেশপ্রেমের পতাকা টানিয়ে হোক। যখনই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা অঞ্চলভিত্তিক সংগঠিত কোনো লোকসকল নিজেদেরকে আলাদা একটি সম্প্রদায় মনে করবে তখনই তাদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতাবোধ, স্বজাত্যপ্রেম প্রস্ফুটিত হবে। এটা মানবপ্রজাতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মুসলিমরা হিন্দুদের চেয়ে নিজেদের মহত মনে করবে, বৃটিশ নরম্যানরা স্যাক্সনদের চেয়ে মহত্তর হয়ে যাবে, ব্রাহ্মণরা শূদ্রের চেয়ে অধিক দাবিদার হবে স্বর্গের। এটা থাকবেই। যতোদিন ধর্ম থাকবে, মানুষের মাঝে আলাদা বর্ণ, আলাদা গোত্র, অঞ্চল থাকবে ততোদিন সাম্প্রদায়িকতা থাকবে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। পৃথিবীর যুদ্ধইতিহাস দেখুন, অধিকাংশ রক্তই ঝরেছে এই সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির উদগ্রতায়। ধর্মযুদ্ধে যতো মানুষ নিহত হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ বেশি মানুষ নিহত হয়েছে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে।

আমরা নিজেদেরকে যতোই সুসভ্য মনে করি না কেনো, পৃথিবী সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা কি খুব বেশি সুসভ্য হতে পেরেছি? আদম জন্মের অযুত হাজার বছর পরও মানুষ কেবল এতোটুকুই সভ্য হতে পেরেছে, আগে তারা প্রকৃতির মাঝে গুহায় বসবাস করতো এখন বসবাস করে নিজেদের তৈরি ছাদের নিচে। বাইরে থেকে ভেতরে এসেছে। প্রকৃতির কোল থেকে কৃত্রিম আবরণের নিচে এসেছে। কেবল এতোটুকুই উন্নতি হয়েছে। মানুষের মানসিকতা, মনুষ্যত্ববোধ, প্রবৃত্তি একই রয়ে গেছে, খুব একটা বদলায়নি।

তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি? ধর্ম আমাদের যেহেতু মানতেই হবে, দেশপ্রেম যেহেতু আমাদের সাংবিধানিক অনুপ্রাস সেহেতু সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অধিকার। আপনি যখন ধর্মে-বর্ণে কোনো আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত হবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে সেই সম্প্রদায়ের প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য, সম্মান দেখাতে হবে। কিন্তু এই ভালোবাসা-আনুগত্যের নিশ্চয় একটা সীমা আছে। সীমাহীন ভালোবাসার অপর নাম নির্যাতন; সম্ভবত সাম্প্রদায়িকতাও এর থেকেই উদ্গত। এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের বহুল ব্যবহৃত ‘সাম্প্রদায়িকতা’। সুতরাং আপনাকে একটা সীমা মেইনটেইন করতে হবে।

ধর্মের আবডালেই সাম্প্রদায়িকতা সবচেয়ে বেশি উর্বর। তাই বলে কেউ কি বলতে পারবে ধর্ম মাত্রই সাম্প্রদায়িক? পরধর্ম অসহিষ্ণু? ইসলামধর্মের কথা যদি বলি, কোরআন-হাদিসের কোথাও কিন্তু অপর ধর্মকে হেয় করে কিছু বলা হয়নি। কোরআনে স্পষ্ট এসেছে -‘এক আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য দেব-দেবীর উপাসনা যারা করে, তাদের উপাস্যদের তোমরা গালি দিও না।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১০৮)

হাদিসের একটি কিংবদন্তি দেখুন, রাসুল মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অবিচার করে তাহলে আমি কিয়ামতের ময়দানে সেই মুসলিমের বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করবো।’ (আবু দাউদ শরিফ)

হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ, খিস্টান, শিয়া বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা আছে তাদের ধর্মেও কিন্তু এরকম পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথাই বলা আছে। তবুও ধর্মের নামে পাকিস্তানে মানুষ মরে। কেনো? রোহিঙ্গারা মায়ানমারের রাস্তায় পড়ে কাতরায় কেনো? নাইজেরিয়ার গির্জায় বোমাহামলা হয় কেনো? তিব্বতে কেনো বুদ্ধের অহিংসতা প্রতিফল দেয় না?

আসলে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ধর্ম নেই, কোনো দেশ নেই, আলাদা বর্ণ নেই, বর্ণমালাও নেই। একজন কাপুরুষের শেষ আশ্রয় যেমন দেশপ্রেম তেমনি একজন মোনাফেকের শেষ আশ্রয় হলো ধর্ম। ধর্মের বোরকা চড়িয়ে ধর্মকে আঘাত করাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। আমি ইসলাম ধর্মের কথা বলছি, আরবের নবি মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন সেই ইসলামের কথা বলছি। যিনি নিজের চাচা ও দুধভাই হামজার হত্যাকারীকে নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

খলিফা উমরের শাসনকাল। প্রখ্যাত সাহাবি আমর ইবনুল আস মিসরের শাসক। হঠাৎ একদিন দেখা গেলো রাতের আঁধারে কে যেনো বিধর্মীদের উপাসনালয়ে ঢুকে প্রধান মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলেছে। বিধর্মীরা ক্ষেপে গিয়ে গভর্নরের কাছে নালিশ দিলো – একাজ তো মুসলমান ছাড়া অন্য কেউ করতে পারে না। অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। আমাদের মূর্তিকে নাক ভেঙ্গে অপমান করার কারণে তারও নাক কেটে শাস্তি দিতে হবে।

আমর ইবনুল আস মিসরের জনগণের দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নর ছিলেন, কেবল মুসলমানদের সেনাপতিই ছিলেন না। তখনই ঘোষণা দিলেনÑ যে এই কাজ করেছে সে যেনো তার অপরাধ স্বীকার করে নেয়। সময় তিনদিন। একদিন দুদিন করে তৃতীয়দিনও এসে গেলো। কেউ অপরাধ স্বীকার করলো না। মূর্তিপূজকরা এসে গভর্নরের দরবারে বসে রইলো বিচারের আশায়। নির্ধারিত সময়ের পরও যখন কেউ এলো না তখন গভর্নর নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন। হাতে ছুরি। ঘোষণা করলেন, যেহেতু একজন শাসক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি, জনগণের সম্পদের নিরাপত্তা দিতে পারিনি তাই এ অপরাধের শাস্তি আমি নিজেই মাথা পেতে নিচ্ছি। আমার ঘোষিত শাস্তি হিসেবে আমার নাক কাটা হোক। জল্লাদকে ডাকা হলো। জল্লাদ তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত। নাক কাটার ঠিক আগমুহূর্তে সমবেত মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিলোÑ আমিই ভেঙ্গেছি মূর্তির নাক। দরবারজুড়ে পিনপতন নীরবতা। সবাই তাকিয়ে আছে স্বীকারোক্তি দেয়া প্রকৃত অপরাধীর দিকে। কারো মুখে কোনো কথা সরছে না। বাহ্, বাহ্, বাহ্Ñবলে উঠলো মূর্তিপূজকদের একজন, এমন আত্মত্যাগের মহিমা এর আগে আমি কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ধন্য তোমাদের ধর্ম! ধন্য তোমাদের আদর্শ!

রামুতে সম্প্রতি একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। পোড়ানো হয়েছে মূর্তি ও ধর্মীয় তৈজসপত্র। ইন্টারনেটে একটি ব্লগে ঘটনার সময়কার কয়েকটি ছবি দেখলাম। কয়েকজনকে দেখা যায় উপাসনালয়ের ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন জিনিস ভাংচুর করছে, কেউ সরিয়ে নিচ্ছে দামি জিনিসপত্র। কেউ কেউ লুঙ্গিতে মালকোচা কাছা মেরে এই ‘জিহাদে’ শরিক হয়েছেন। হাফপ্যান্টও আছে কয়েকজনের পরনে। এরা সবাই এলাকার ঈমানদার ‘মুসলমান’(!) ইসলামের বীর সেনানী। উপাসনালয় গুড়িয়ে দেয়ার মহান জিহাদে শামিল হয়েছে।

সংখ্যালঘুদের অধিকার ইসলামে কতোটুকু এবং একজন মুসলমান হিসেবে তা কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে উপরোক্ত কোরআনের আয়াত, হাদিস এবং ইতিহাসপাঠে আশা করি কিছুটা হলেও খোলাসা হয়েছে। তবুও কিন্তু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। কেননা আমাদের রাষ্ট্র কিংবা সরকার, নিদেনপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোও কিন্তু এই সংখ্যালঘু ইস্যুটিকে বেশ ভালো একটা উপাদেয় বস্তু বানিয়ে রেখেছে সবসময়। সময় সুযোগমতো তারা এই ইস্যু ব্যবহার করে। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারগুলো পড়–ন, সেখানে খুব ফলাও করে বলা আছে সংখ্যালঘুদের হেন অধিকার তেন অধিকারের কথা। কী অবাক কাণ্ড! তাকে বাংলাদেশি বলেই যদি স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে তাহলে তার জন্য আলাদা করে সুযোগ সুবিধার কথা বলা হচ্ছে কেনো? তার মানে কি এই নয় যে, ক্ষমতায় এলেও এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে না? আর পাবে না বলেই তাদের জন্য নির্বাচনী ইশতেহারে আলাদা বরাদ্দ রাখতে হয়। এটা কি সাম্প্রদায়িকতা নয়?

আরেকটি বিষয় ভাবুন। গড়পড়তায় দেশে প্রতিদিন ৩০-৪০টি খুন হচ্ছে, ৮০-১০০টি নারী নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, ১০জন নারী ধর্ষিত হচ্ছে; অন্তত সংবাদপত্রে আমরা এমনই খবর পাই। এই ৫০টি খুনের মধ্যে কি দুজন হিন্দু থাকা, ১০০টি নারী নির্যাতনের ঘটনায় ৫জন হিন্দুনারী থাকা কিংবা দশজনে একজন কিশোরী ধর্ষিত হওয়াটা পরিস্যংখানত দিক দিয়ে । হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশির এদেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠি। মূল জনসংখ্যার তারা প্রায় ৮ থেকে ১০ ভাগ। কিন্তু পত্রিকার পাতায় সংবাদ আসে – ‘একজন সংখ্যালঘু খুন’ ‘সংখ্যালঘু কিশোরী ধর্ষিত’। সংখ্যালঘু বলেই কি তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দিতে হবে যে, তুই সংখ্যালঘু? কেনো মিডিয়া তাকে সংখ্যালঘু বলবে? কী কারণে তাকে ভিন্নধর্ম মতাবলম্বী বলবে? সে কি বাংলাদেশের নাগরিক নয়? ধর্ম দিয়ে কেনো তাকে আলাদা নামে ডাকা হবে? সমাজের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে সব জায়গায় চলে এই বিভাজন। রাষ্ট্রীয় কাঠামো দিয়ে যদি বাংলাদেশ নামে কোনো দেশ থেকে থাকে তবে তার নাগরিকদের পরিচয় হবে বাংলাদেশি হিসেবে। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে সবধর্মের লোকদেরই রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার। ‘সংখ্যালঘু’ এই শব্দটাকেই অভিধান থেকে তুলে দেয়া দরকার। তারা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে জন্ম নিয়েছে, সুতরাং তারা বাংলাদেশি। ধর্মবিচারে ভিন্ন কোনো পরিচয়ে তাদের পরিচিত করার নামই সাম্প্রদায়িকতা।

এ দেশে সংখ্যালঘু তত্ত্বের সবচে বড়ো সমঝদার এদেশের এনজিওগুলো। এতে অবশ্য তাদের আলাদা ফায়দা আছে। তারা যতোবেশি সংখ্যালঘু খুঁজে বের করতে পারবে, ততোবেশি বিদেশি দান-খয়রাত পাবে। তাই তাদের কাজই হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে সংখ্যালঘু খোঁজা। এরাও সেবার কারবারের নামে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখে। সংখ্যালঘু না থাকলে তো এদের কারবারই বন্ধ হয়ে যাবে!

মাটির একটা প্রভাব আসলেই আছে। বাতাসের প্রভাব, বৃষ্টির প্রভাব, সবুজের প্রভাব একজন মানুষের মাঝে না থেকে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ তুলনা করার মতো। পাশের দেশ ভারতে সম্প্রদায়গত যতো দাঙ্গা হয়েছে বাংলাদেশে তার সিকিভাগও হয়নি। এটা একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের গর্ব করার বিষয়। সর্বোপরি ইসলামের সঠিক আদর্শ যদি মানুষের মাঝে আদর্শিক মনুষ্যত্ব জাগ্রত করে তবে সাম্প্রদায়িকতা বলে ভিন্ন কোনো অভিধার কোনো প্রয়োজনই হবে না কোনোদিন। ইসলাম আমাদের মাঝে সেই মনুষ্যত্ব জাগ্রত করুক।