আমি আপনাদের বার বার বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা করতে বলি। বলি যে, আন্দালুস, তুর্কি, মধ্যএশিয়া, আফগান, হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাঠ করে অনেক তো কান্নাকাটি করলেন। এবার বাংলায় ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস পাঠ করে একটু কান্না চর্চা করেন। আপনারা সে কথা কানেই তুলেন না। ফলে আজ দেখেন, হাই স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ঠিকই এ দেশের মুসলিম ইতিহাসকে বলা হচ্ছে বিদেশি অনুপ্রবেশ আর হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে বলা হচ্ছে এখানকার আদি ও আসল ইতিহাস।
কিন্তু সত্যটা কী?
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ খিলজি বঙ্গ বিজয়ের আগে এই অঞ্চল শাসন করেছে সেন সাম্রাজ্য (১০৭০-১২৩০ (আংশিক)। সেন বংশ বাঙালি ছিল না, তারা ছিল দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের অধিবাসী। তার আগে শাসন করেছে পাল রাজারা (৭৫০-১১৬১ (আংশিক)। এই রাজবংশের প্রথম পুরুষ গোপালের বংশপরিচয় জানা যায় না। কোনো ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে দাবি করতে পারেননি যে তিনি বাঙালি ছিলেন।
এই দুই সাম্রাজ্যের আগে বহু শতাব্দী বঙ্গ অঞ্চল শাসন করেছে মগধ সাম্রাজ্য, মোর্য্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, গৌড় সাম্রাজ্য। এদের কেউই বাঙালি বংশোদ্ভূত ছিল না। শুধুমাত্র গৌড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা শশাঙ্কের ব্যাপারে বলা হয়, তিনিই একমাত্র রাজা ছিলেন যিনি এসব ভিনদেশীকে হটিয়ে প্রথম বঙ্গের স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন (৬০৬-৬৩৭ (আনুমানিক)। তিনি বাঙালি ছিলেন কি-না, এ ব্যাপারেও প্রশ্ন রয়েছে।
তো, এই হলো বঙ্গ অঞ্চলের দুই হাজার বছরের নিকট ইতিহাস। এর মধ্যে এক শশাঙ্ক ছাড়া আর কোনো রাজা বা সম্রাটের ব্যাপারে দাবি করার উপায় নেই যে তিনি বা তারা বাঙালি বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাহলে এসব হিন্দু ও বৌদ্ধ সাম্রাজ্য যদি বাংলার অনুপ্রবেশকারী বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শাসন না হয় তাহলে মুসলিম শাসনকে কেন অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে? কেনই বা এই বিদ্বেষভরা সিলেবাস পড়ানো হচ্ছে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে?
এসব বইয়ে হিন্দু সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও সম্রাটদের গুণকীর্তন করে ফেনা তুলে ফেলা হয়েছে, আর মুসলিম শাসনকে বলা হয়েছে বিদেশি শাসন। কেন? কারণ আপনি-আমি এই মুসলিম শাসনকে আমাদের ‘নিজেদের ইতিহাস’ বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি যে, আমরাই সময়ের প্রয়োজনে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনকে তুচ্ছ করে মুসলিম শাসনকে গ্রহণ করেছি।
এই দাবি যতক্ষণ আপনি প্রতিষ্ঠা না করতে পারবেন ততক্ষণ আপনার ইতিহাস এভাবেই চুরি হতে থাকবে। আর আপনি ফেসবুকে এসে মায়াকান্না কাঁদতে থাকবেন।